এলাহাবাদ চুক্তি

মুঘল শাসনাধীন বাংলার দেওয়ানের পদ এবং সুবেদার পদ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির উপর ন্যস্ত ছিল। দিল্লির সম্রাট নিজে তাদের নিয়োগ দিতেন। তারা উভয়ই সম্রাটের নিকট জবাবদিহি করতেন। তারা একে অপরকে প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করতেন, কিন্তু একে অন্যকে অধীনস্থ করতে পারতেন না। দেওয়ানের কাজ ছিল রাজস্ব আদায় অপরদিকে বিচার, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য কাজের দায়িত্ব ছিলে সুবেদারের উপর। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য কোন প্রাদেশিক শাসনকর্তা যেন বেসামাল না হয়ে পড়ে, স্বাধীনতাকামী না হয়ে পড়ে, সেই উদ্দেশ্যেই এই ক্ষমতা বিভাগের ব্যবস্থা ছিল।

১৭১৭ সালে সুবেদারের দায়িত্ব প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত মুর্শিদ কুলি খান বাংলার দিউয়ান ছিলেন। তবে মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসনকারী এই নবাব এবং তাঁর উত্তরসূরীরা একইসঙ্গে সুবাদার ও দিউয়ানের দায়িত্ব পালন করতেন। শুধু তাই নয়, মারাঠা উৎপাতের কারণে আলীবর্দী খান কেন্দ্রকে রাজস্ব পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে সিরাজউদ্দৌলা ও মীরজাফরের আমলে কেন্দ্রকে রাজস্ব দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানি হয়ে ওঠে পুরো দেশের হর্তাকর্তা। তারপর কেন্দীর রাজনীতি তথা সমগ্র উপমহাদেশের রাজনীতি বদলে যায়। তখন সবকিছু এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যা থেকে উত্তোরণের পথ ছিল না। ফলে সুবে বাংলা আবার আগের মতো দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানো বন্ধ করে দেয়। বলতে গেলে তখনকার দিল্লির সম্রাট শাহ আলম বাংলা থেকে রাজস্ব প্রাপ্তির আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন।

এমনি পরিস্থিতিতে সম্রাট কয়েকবার কোম্পানিকে বাৎসরিক কিছু উপঢৌকনের বদলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দিউয়ানি গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তখন তার সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল । পরে বক্সার যুদ্ধের পর কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা চরমে ওঠে। তাদের হঠকারিতায় বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ খারাপ হয়। ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ কোম্পানির দুর্নীতি দমন ও স্বার্থ বৃদ্ধির জন্য ক্লাইভকে লর্ড উপাধি দিয়ে আবার বাংলায় প্রেরণ করে (১৭৬৫-১৭৬৭ খ্রি:)।

বাংলায় এসে ক্লাইভ মীর কাশিমের মিত্রশক্তি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের প্রতি নজর দেন। বক্সার যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ তাদের নিকট থেকে ৫০ লক্ষ টাকা এবং কারা ও এলাহাবাদ জেলা দু’টির দখল নেয়া হয়। এরপর তিনি অযোধ্যার নবাবের সাথে মিত্রতা স্থাপনের পাশাপাশি দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথেও সন্ধি স্থাপন করেছিলেন।

এলাহাবাদ চুক্তি অনুসারে (১৭৬৫) দিল্লির সম্রাট শাহ আলম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা বা দীউয়ানি প্রদান করেন। কোম্পানি কোরা ও এলাহাবাদকে সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্মত হয়।

এলাহাবাদের আরেকটি চুক্তিটি হয় মীর জাফরের নাবালক পুত্র নবাব নাজিম-উদ-দ্দৌলার সঙ্গে। কোম্পানির পক্ষে লর্ড ক্লাইভ নবাব নাজিম-উদ-দ্দৌলার সঙ্গে চুক্তির দ্বারা স্থির করেন যে, নবাব ৫৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিজামত অর্থাৎ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহন করবেন এবং রাজস্ব আদায়ের অধিকার স্বয়ং কোম্পানির হাতে থাকবে অর্থাৎ নবাব পেল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং কোম্পানী পেল দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এই ব্যবস্থা ইতিহাসে দ্বৈতশাসন নামে পরিচিত।

১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হয়ে এসে সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা প্রদানের চুক্তি বাতিল করেন এবং এলাহাবাদ ও কোরা অঞ্চলদ্বয় সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে অযোধ্যার নবাবকে প্রদান করেন।

Add a Comment