ফরাসী বিপ্লব

ফরাসী বিপ্লব (French Revolution):
সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা এ তিন আদর্শকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিলো ফরাসী বিপ্লবের। ফরাসি দার্শনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের চিন্তা চেতনার ফল ফরাসী বিপ্লব। ফ্রান্সের জনগনের ফরাসী বিপ্লব কে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সঙ্গে স্মরন করে।

ফরাসি বিপ্লব কি?
ফরাসি বিপ্লব ছিল তদানীন্তন ফ্রান্সের শত শত বছর ধরে নির্যাতিত ও বঞ্চিত ‘থার্ড স্টেট’ বা সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই বিপ্লবের আগে সমগ্র ফ্রান্সের ৯৫ ভাগ সম্পত্তির মালিক ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষ, অথচ সেই ৫ ভাগ মানুষও কোনও আয়কর দিত না। অথচ যারা আয়কর দিত তারা তেমন কোনও সুযোগ ভোগ করতে পারত না। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করত তাদের বাস্তিল দুর্গে বন্দি করে নির্যাতন করা হত।

french পূর্ববর্তী রাজাদের যুদ্ধনীতি ও বিলাসব্যসনের কারণে ষোড়শ লুই-এর আমলে মারাত্মক আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়। কর বৃদ্ধি করা ছাড়া আর্থিক সংস্থানের কোনও বিকল্প ছিল না। সমস্যা সমাধানের জন্য রাজা অর্থ সচিব নেকারের পরামর্শ চান। নেকার স্টেট জেনারেলের বৈঠক না ডেকে কর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। অথচ ১৭৫ বছর ধরে স্টেট জেনারেলের অধিবেশন হয় না। নিরুপায় রাজা প্রস্তাবে সম্মত হন। কিন্তু থার্ড স্টেট-এর নেতৃবৃন্দ সুযোগ বুঝে দাবি তোলেন, নির্বাচনের আগে তাঁদের সদস্য সংখ্যা অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের মোট সংখ্যার (৬০০=৩০০+৩০০) সমান করতে হবে। ১৭৮৮ সালের ডিসেম্বরে রাজা দাবি মেনে নেন। নির্বাচনের আগেই সিদ্ধান্ত হয় যে, ১৭৮৯ সালের ৫ মে নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে স্টেট জেনারেলের অধিবেশন বসবে।

এপ্রিল মাসের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলাফলে দেখা যায় যে, অভিজাত ও যাজকদের মোট নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা হয় ৫৬১টি। অপর দিকে থার্ড স্টেট বা তৃতীয় সম্প্রদায় একাই লাভ করে ৫৭৮টি আসন। বিভিন্ন কারণে তিন ক্যাটাগরি থেকে সর্বমোট ৬১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণির প্রাধান্য স্পষ্ট ভাবে নির্ধারিত হয়।

কিন্তু রাজা তৃতীয় সম্প্রদায় ছাড়াই অধিবেশনে বসেন এবং কর প্রস্তাব দেন। তৃতীয় শ্রেণির সদস্যরা সভাকক্ষে ঢুকতে না পেরে অপমানিত বোধ করেন। ১৭ জুন তাঁরা নিজেদের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দেন। ২০ জুন থার্ড স্টেটের প্রতিনিধিরা সভাস্থলের পাশে একটি টেনিস কোর্টে এক বৈঠকে মিলিত হন, যাতে যাজক এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের বেশ কিছু সদস্য যোগ দেন , এবং তারা একই সাথে শপথ নেন যে যত দিন ফ্রান্সের জন্য তাঁরা একটি সংবিধান রচনা সম্পন্ন না করতে পারবেন তত দিন তাঁরা একত্রে থাকবেন।

এই শপথ নামা টেনিস কোর্টের শপথ নামে পরিচিত। ২৩ জুন রাজা ঘোষণা করেন, থার্ড স্টেটের দাবি মেনে নেওয়া যাবে না এবং থার্ড স্টেটের প্রতিনিধিদের রাজপথ থেকে সরে যেতে বলেন, এতে প্রতিনিধিরা রাজি না হওয়ায় পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।

১৩ জুলাই হাজার হাজার মানুষ প্যারিসের পৌর ভবনের সামনে জড়ো হন এবং একটি রক্ষীবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। খুব সল্প সময়ের মধ্যে রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেড়ে ১২ হাজারে পৌঁছে যায়। ১৪ তারিখ নির্বাচিত প্রতিনিধি, রক্ষীবাহিনীর সদস্য এবং বাস্তিল দুর্গের আশেপাশের মানুষ বাস্তিল অভিমুখে রওনা হয়।

প্রতিনিধিরা রক্তক্ষয় এড়াতে বাস্তিল দুর্গের প্রধান দ্য লোনের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। লক্ষ্য ছিল বাস্তিলে অবস্থিত ৭ জন রাজবন্দিকে মুক্ত করা এবং বাস্তিলে রক্ষিত অস্ত্রসমূহ জনগণের হাতে তুলে দেওয়া এবং কামানগুলো অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়া কিন্তু দ্য লোন প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দেয়। জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে, জনতার ঢেউ আছড়ে পড়ে বাস্তিল দুর্গে, বাস্তিলের রক্ষীরাও কামান দাগাতে শুরু করে, প্রায় দুশো বিপ্লবী মানুষ হতাহত হয়। এর পর চারিদিক থেকে উত্তেজিত ক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল ধ্বংস করে। পতন হয় স্বৈরাচারী শাসকের, ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয় শোষিত, নির্যাতিত মানুষের জয়ের নতুন এক উপাখ্যান যার নাম “ফরাসি বিপ্লব”। ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’ ছিল ঐতিহাসিক স্লোগান।

Add a Comment