তালেবান

তালেবান/তালিবান কী/কারা?
“তালিবান” শব্দের অর্থ “ছাত্র”। সংগঠনটির এরূপ নাম করনের কারন পস্তু ও দক্ষিণ-পূর্ব আফগান এলাকার অনেক মাদ্রাসা ছাত্র এই সংগঠনে যোগ দেয়। ১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকে মুসলিম আফগান যোদ্ধাদের একটি অংশ নিয়ে তালেবান গঠিত হয়। এরা আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির (১৯৭৯-৮৯) বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছিল। সোভিয়েত সেনারা সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের নেতৃত্বে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুবিধা নেয় তালেবান। যুদ্ধবিগ্রহ আর অস্থিতিশীলতায় ক্লান্ত জনগণ তখন শান্তির আশায় তালেবানকে স্বাগত জানিয়েছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তান থেকে তাদের প্রভাব ক্রমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট বোরহানউদ্দিন রব্বানির সরকারকে উৎখাত করে রাজধানী কাবুল দখল করে তালেবান। বর্তমানেও দৃঢ় চেতনার অধিকারী তালিবান সমর্থকেরা পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের উপজাতীয় অঞ্চলে ক্ষমতাসীন আফগান সরকার, অপারেশন এন্ডিউরিং ফ্রিডম-এ অংশগ্রহণকারী ন্যাটো সৈন্যবাহিনী এবং ন্যাটো পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্টেন্স ফোর্সের (আইএসএএফ) বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

সংগঠন
তালিবান আন্দোলনের প্রধান ছিলেন মোল্লা মুহাম্মাদ উমার। উমারের পরেই ছিল সামরিক কমান্ডার ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের একটি মিশ্র ইউনিটের অবস্থান। এর পরে স্থান ছিল পদমর্যাদা অনুযায়ী পাকিস্তানের বিভিন্ন ধর্মীয় বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের। দক্ষিণ আফগানিস্তানের পশতুন অঞ্চল ও পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু অঞ্চলে তালিবান আন্দোলন সবচেয়ে ব্যাপক রূপ ধারণ করেছিল। এছাড়াও ইউরোপ ও চীন থেকে কিছু স্বেচ্ছাসেবক এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তালিবানরা বিভিন্ন উৎস থেকে ভারী অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সহযোগিতা লাভ করেছিল। পাকিস্তান সরকার বিশেষত ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স তালিবানদের সহায়তার জন্য অভিযুক্ত হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের জন্য নির্মীত মাদ্রাসাগুলো থেকে অনেকেই সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এই মাদ্রাসাগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল জামিয়াত উলামা-ই-ইসলাম। মৌলভি হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা বর্তমান তালেবান নেতা।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তালিবান
পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে তালিবানরা আফগান রাজধানী কাবুলে ক্ষমতাসীন ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র তিনটি দেশ তাদেরকে স্বীকৃত দিয়েছিল: পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। মানবাধিকার লংঘনের জন্য আফগানিস্তান জাতিসংঘের স্বীকৃতি হারিয়েছিল এবং ইরান, ভারত, তুরস্ক, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশ তালিবান শাসনের বিরোধিতা করেছিল এবং তালিবান বিরোধী আফগান নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সাহায্য করেছিল।

তালেবান শাসন
১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান, আফগানিস্তানের তিন-চতুর্থাংশ দখল করে শাসন করে। ক্ষমতায় থাকার সময় তালিবানরা এযাবৎ কালের সবচেয়ে কঠোর মুসলিম শরিয়াহ্‌ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। নারীদের প্রতি বিরূপ আচরণের জন্য তারা আন্তর্জাতিক মহলে অনেক নিন্দিত হয়েছিল। নারীদের বোরকা পরতে বাধ্য করা হতো, আট বছর বয়সের পর তাদেরকে চাকরি বা শিক্ষা লাভ করতে দেয়া হতো না। যারা পড়তে চাইতো তাদেরকে ভূগর্ভস্থ বিদ্যালয়ে পাঠানো হতো এবং কারও সাথে অনৈসলামিক অবস্থায় ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো। পুরুষ ডাক্তাররা তাদেরকে চিকিৎসা করতে পারতো না। একান্তই করাতে হলে, সাথে করে কোন পুরুষ আত্মীয় বা স্বামী নিয়ে আসতে হতো। বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা নারীদের কোনো সাবালক ছেলে সন্তান না থাকলে, তারা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতেও সাহায্যের জন্য যেতে পারত না, তাই তারা বিনা চিকিৎসায় কষ্ট ভোগী হয়ে থাকত, যেহেতু তারা একা চিকিৎসকের কাছে যেতে পারত না।যেসব বিধবাদের ছেলে সন্তান ছিল না, তারা ঘরের বাইরে যেতে পারত না বলে না খেয়ে মারা যেত। নারীদের জীবন ঘরের ভিতরে জন্ম নিয়ে ঘরের অন্ধকারেই শেষ হয়ে যেত। এই পৃথিবীতে আলো নামে যে কোনো জিনিস আছে তা তারা জানতোই না।পুরুষেরা নারীকে পশুর চেয়েও নিচে ভাবত। নারী নির্যাতন এসময় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। পুরুষ-নারী সবাইকেই তালিবান আইন ভঙ্গ করার জন্য কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো।

মার্কিন হামলা
‘টুইন টাওয়ার’ হামলার পর ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে হামলা শুরু করে। ওই বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল- ওসামা বিন লাদেন টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে, আফগানিস্তানে লুকিয়ে আছে, তারা আফগান সরকারকে ওসামা বিন লাদেন কে ধরিয়ে দিতে বলে। আফগান সরকার এতে অস্বিকৃতি জানালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে ও তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে।

শান্তিচুক্তি
তালেবান শাসনের পতনের পর গোষ্ঠীটির সদস্যরা একটি শান্তি চুক্তি গ্রহণ করতে রাজি ছিল, যা তাদের দেশে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার সুযোগ দিত। কিন্তু আফগানিস্তানের ভেতরে ও বাইরের রাজনীতিবিদেরা এবং সিদ্ধান্তপ্রণেতারা তাঁদের সিদ্ধান্তমূলক এই বিজয়ে একেবারে জ্ঞানহারা হয়ে যান। তাঁরা কোনো ধরনের চুক্তি করতে অস্বীকার করেন এবং আলোচনার টেবিল থেকে তালেবানকে হটিয়ে দেন। জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তাঁরা তালেবানের সবচেয়ে মৌলিক চাহিদাগুলো সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেন এবং কঠোরভাবে তালেবানবিরোধী সরকার গঠনে সহায়তা করেন। এটা ছিল মৌলিক একটি ভুল, যা আফগানিস্তানকে যুদ্ধ ও রক্তপাতের দিকে ঠেলে দেয় এবং আমাদের আজকের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

গত ১৭ বছরে অগণিত তালেবান নেতা মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত, অপমানিত ও বিদেশে নির্বাসিত হয়েছেন। অনেককে পাঠানো হয়েছে গুয়ানতানামো ও বাগরামে। সেখানে তাঁরা অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর এসব কারণে তালেবান সদস্যরা মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করাকে পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে।

তালেবান কী চায়?
এখন একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন হিসেবে তালেবান দুটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। একটি হচ্ছে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্যের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং একটি সমন্বিত ইসলামিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
এ ছাড়া তালেবানের আরও কিছু ছোটখাটো দাবি রয়েছে। তারা চায় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে তার নেতাদের নাম প্রত্যাহার করা হোক, তাদের বন্দীদের মুক্ত করা হোক এবং দোহায় তাদের রাজনৈতিক কার্যালয়কে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। ২০০১ সালে পরাজয়ের পরের সময়ের মতো, তালেবান এখন বিশ্বাস করে যে একটি চুক্তির পর আফগানিস্তানে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে থাকার অধিকার তারা অর্জন করেছে।

Add a Comment