সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা(২/৪)
|সপ্তম পরিকল্পনার উন্নয়ন পদ্ধতি
ষষ্ঠ পরিকল্পনার অধীনে সুষ্ঠুভাবে উন্নয়ন কর্মসম্পাদন এই ধারণাকে সামনে আনে যে, সরকার গৃহীত উন্নয়ন কৌশল সঠিক খাতে রয়েছে। এখন সাফল্যের এই ভিত্তির ওপরেই বিনির্মাণ কাজকে এগিয়ে নেয়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এর সমান্তরালে পূর্বতন পরিকল্পনার ছোটখাট বিচ্যুতি সমাধানের লক্ষ্যেও অধিকতর কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সবচাইতে যেটি গুরুত্বিপূর্ণ তাহলো, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১৬ থেকে ২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত বিস্তৃত, এবং এমন একটি সময়ে এটি শুরু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ যখন সবেমাত্র মধ্য আয়ের দেশগুলোর মর্যাদায় প্রবেশ করেছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছরে একই সাথে জাতিসংঘের ২০১৫-উত্তর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কৌশল গড়ে উঠেছে চারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুকে ঘিরে-
- বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হার ৬% প্রবৃদ্ধির গোলক ভেঙে বের করে এনে তা ৭% এ উন্নীতকরণ।
- প্রবৃদ্ধি হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, দরিদ্রমুখী, নগরায়ণ রূপান্তর প্রক্রিয়ার সাথে সুসঙ্গতিপূর্ণ এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই।
- সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদ শেষে দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।
- অধিকাংশ ছদ্ম-বেকারসহ অতিরিক্ত শ্রমশক্তির সকলের জন্য লাভজনক কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তিঃ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ক্রমান্বয়ে ২০১৫ সালের ৬.৫% থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৮% এ উন্নীত করা। সপ্তম পরিকল্পনা মেয়াদে গড় প্রবৃদ্ধি হার ৭.৪% প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। ৭% + হারে দ্রুত অর্থ নৈতিক প্রবৃদ্ধি কৌশল বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ধারাকে চলমান রূপান্তর প্রক্রিয়ার সাথে অন্তর্ভূক্ত, সক্রিয় ও অভিযোজন করতে সম্পূরক কৌশল ও নীতিমালা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে। ফলে এই প্রবৃদ্ধি হবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংগতিপূর্ণ এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রাকৃতিক পরিবেশের কোন ক্ষতি সাধন না করে তা হবে টেকসই। সুতরাং এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কৌশল অনুসৃত হবে, যা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, অধিকতর শ্রমশক্তির বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণের জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে, বাজার চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা দিয়ে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণপ্রাপ্তি সহজগম্য করে এবং জনগণকে অধিকতর উৎপাদনক্ষম রাখতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি করে মূলত জনগণকেই ক্ষমতাবান করে তুলবে। অন্তর্ভুক্তি এভাবে শুধুমাত্র আয় বৃদ্ধি করবে না, বরং তা প্রান্তিক ও শারীরিকভাবে সমস্যাযুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন নতুন সুযোগ, উৎপাদনমূলক কর্মসংস্থান ও বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে।
প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনঃ আমাদের ১৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশের অবস্থান এখনো দারিদ্র্য রেখার নিচে, এই পরিস্থিতিতে দারিদ্র্য মোকাবেলার জন্য সবচাইতে যেটি বেশি প্রয়োজন তাহলো দ্রুত প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। তাই দারিদ্র্য সমস্যা মোকাবেলার সময়, যতখানি সম্ভব^ চরম দারিদ্র্য (যা দারিদ্র্য রেখার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী নির্দেশ করে) কমিয়ে আনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হবে। বিশেষ করে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্বিষ্ট হলো ২০২০ অর্থবছর নাগাদ দারিদ্র্য হার ১৮.৬% এবং চরম দারিদ্র্য হার ৮.৯% এ হ্রাস করা। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পাশাপাশি তাই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমন্বিত দারিদ্র্য নিরসন কৌশলের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে মানব উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দেয়া হবে।
প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সমস্যাঃ অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে সেই ধরনের প্রবৃদ্ধি যা কর্মসংস্থানের দিক থেকে একই সঙ্গে টেকসই ও ব্যাপকভিত্তিক এবং যার সুফল প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর কাছে সহজেই পৌঁছানো যায়। সপ্তম পরিকল্পনার পাঁচ বছরে প্রায় ১২.৯ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের যোগান দেয়া যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে এবং ঐ একই সময়ে প্রায় ২ মিলিয়ন অভিবাসী শ্রমিকের জন্য বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরি সহ দেশে প্রায় ৯.৯ মিলিয়ন অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাজারে এভাবে যে কর্মসুযোগ তৈরি হবে তা জিডিপি প্রবৃদ্ধির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেলে অতিরিক্ত শ্রমশক্তি সহ কর্মসন্ধানী শ্রমিকদের নিয়োজন চাহিদা পূরণের পর অর্ধবেকারত্ব সমস্যার সমাধানে সমর্থ হবে। সমষ্টিগতভাবে এবং খাত পর্যায়ে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ভৌত ও মানব পুঁজিতে উচ্চতর বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগের অর্থায়ন এমনভাবে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে তা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় কোন সমস্যা তৈরি না করে। বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও অব্যাহত থাকবে। এভাবে ২০২০ অর্থবছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে ৫.৫% এ নামিয়ে আনার প্রচেষ্টার সাথে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার সমন্বয় সাধন করা হবে। একটি শক্তিশালী ও বহুমুখী রপ্তানিভিত্তি প্রবর্ধনের ব্যালান্স অব পেমেন্টের সুষ্ঠু কর্মসম্পাদনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হবে। ষষ্ঠ পরিকল্পনার অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্য অর্জনে বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিমেয়। তাই পরিকল্পনা মেয়াদের মধ্যে বিনিয়োগ হার জিডিপির প্রায় ৫.৫% বাড়ানো (অর্থাৎ ২০১৫ অর্থবছরে জিডিপির ২৮.৯% থেকে পরিকল্পনার শেষ বছর ২০২০ অর্থবছরে তা ৩৪.৪% এ উন্নীত করা) হবে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে বিনিয়োগ হার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এছাড়াও, সীমিত সরকারি খাতের বিনিয়োগ থেকে সর্বোচ্চ সুফল আহরণের জন্য অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, বিশেষ করে সরকারি খাতের বিনিয়োগের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করার গুরুত্ব অনেক বেশি। অতীতের মতো, সরকারি খাতের অধিকাংশ বিনিয়োগ বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ সরকার কর্তৃক চিহ্নিত ৮টি রূপান্তরকারী প্রকল্প এবং প্রধান প্রধান অবকাঠামো প্রকল্প পরিচালিত হবে। অতীতের মতোই আমাদের অর্থনীতির অধিকাংশ বিনিয়োগের অর্থায়ন হতে পারে জাতীয় সঞ্চয় থেকে, যদিও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে। মোট বিনিয়োগে জিডিপির পরিকল্পিত ৭.৫% বৃদ্ধির মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকারে নিয়ে আসা দরকার। বাংলাদেশি রপ্তানির জন্য অধিকতর বাজার প্রবেশ সুবিধা, নতুন প্রযুক্তি ও উন্নত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার স্বার্থেই বর্ধিত বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদ শেষে ৮% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কিছু সমস্যা থাকলেও প্রয়োজনীয় সহায়ক সংস্কার কার্যাবলি এবং সঠিক নীতি গ্রহণ করা হলে এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে, এটি আয়ত্ব করা কঠিন হবে না।
উন্নয়ন ব্যয়ঃ অবকাঠামো সুবিধা উন্নয়নকল্পে গৃহীত জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে উন্নয়ন ব্যয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে। এছাড়াও অন্যান্য প্রধান সড়ক ও সেতু, বিদ্যুৎ খাত প্রকল্প এবং বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) উদ্যোগের প্রেক্ষিতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে ভূমি সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত ও প্রশস্ততর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সার্বজনীন সাধারণ শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিসহ উন্নত জনস্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাকে সবার জন্য সুগম করার মাধ্যমে উন্নততর মানব পুঁজি সৃষ্টি করতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের মতো অগ্রাধিকার সামাজিক খাত কর্মসূচিগুলোতে বাজেটীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সাম্প্রতিককালে গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের পর্যায় ক্রমিক বাস্তবায়ন দেশের সকল গরিব ও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
বার্ষিক বাজেটঃ এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য বাস্তবায়নের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন করা হবে। এই জাতীয় পরিকল্পনায় অর্থায়নের জন্য প্রয়োজন হবে ব্যক্তি ও সরকারি খাতে বর্ধিত সঞ্চয়, ব্যক্তিখাতের জন্য দ্রুত আয় প্রবৃদ্ধি এবং কর নীতি ও কর প্রশাসন সংস্কার ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে বর্ধিত রাজস্ব সংগ্রহ। উন্নততর সরকারি সেবা বিতরণ ও ভর্তুকি/হস্তান্তর কর্মসূচির জন্য সরকারি সম্পদের বিচক্ষণ ব্যয় এবং সরকারি উদ্যোগে উন্নত দক্ষতা এই খাতে সম্পদের দক্ষ ব্যবহার ও উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি।
সম্পদ সমাবেশঃ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাঁচ বছর সময়সীমায় মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ২০১৬ অর্থবছরের (পরিকল্পনার প্রথম বছরের) স্থিরমূল্যে ৩২ ট্রিলিয়ন টাকা। ষষ্ঠ পরিকল্পনা মেয়াদের মতো, ব্যক্তি খাত বিনিয়োগের প্রাধান্য এখানেও যথারীতি অব্যাহত থাকবে এবং এর আয়তন হবে মোট পরিকল্পিত বিনি য়োগের ৭৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিখাত বিনিয়োগ এতে প্রধান ভূমিকা নিলেও, বৈদেশিক বিনিয়োগের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো প্রয়োজন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগ অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ জিডিপি-র ৩% এ উন্নীত করা অত্যন্ত জরুরি। এভাবে, ষষ্ঠ পরিকল্পনার তুলনায় সপ্তম পরিকল্পনায় প্রধানত প্রাইভেট এফডিআই ও প্রাইভেট খাত কর্তৃক বিদেশি মুদ্রার বহিঃঋণ সমবায়ে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য বহিঃঅর্থায়ন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
সরকারি বিনিয়োগে অগ্রাধিকারঃ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান প্রধান লক্ষ্যমাত্রা যেমন দারিদ্র্য নিরসন এবং দরিদ্র ও অরক্ষিতদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা সহ জিডিপির প্রকৃত প্রবৃদ্ধি থেকে সরকারি বিনিয়োগে অগ্রাধিকার স্পষ্ট হয়ে আসবে। এছাড়া, সরকারি বিনিয়োগ কর্মসূচিতে মানব সম্পদ উন্নয়ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়পরতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে টেকসহিতা নিশ্চিতকরণের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হবে।