ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
|দিউয়ানি ও দ্বৈত শাসনের চূড়ান্ত পরিণাম ছিল বাংলায় ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’। দ্বৈত শাসনের দায়িত্বহীনতার ফলে বাংলার জনজীবনে অরাজকতা নেমেছিল যেমন একদিকে, অন্যদিকে অবাধ লুন্ঠন ও যথেচ্ছভাবে রাজস্ব আদায়ের ফলে গ্রাম্যজীবন ধ্বংস হয়ে যায়। একই সঙ্গে পরপর দু’বছর অনাবৃষ্টি ও খরা দেখা দেয়। ফলে ১১৭৬ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৭৭০ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। এটাই ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এসময় টাকায় একমণ হতে চালের মূল্য বেড়ে গিয়ে টাকায় তিন সেরে এসে দাঁড়ায়। খোলাবাজারের খাদ্যশস্য
বেশি লাভের আশায় কোম্পানির কর্মচারীরা মজুদ শুরু করে। ফলে খাদ্যের অভাবে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মারা যায়। দলে দলে সাধারণ মানুষ শুধু খাবারের আশায় কলকাতা, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের দিকে ছুটতে থাকে। তবে কোম্পানির পাশবিক নীতির মুখে এ সময়েও খাজনা মওকুফ করা হয়নি। ইংল্যান্ডের ভয়াবহ ব্ল্যাক ডেথের মত এই দুর্ভিক্ষের মৃত্যুথাবা ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছিল এক অর্থে ভয়ঙ্কর এবং সর্বনাশা। এর ফলে গ্রাম-বাংলা প্রায় জনশূন্য হয়। এই দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ জেলাগুলো ছিল নদীয়া, রাজশাহী, বীরভূম, বর্ধমান, যশোহর, মালদহ, পূর্ণিয়া ও চব্বিশ পরগণা। অন্যদিকে বরিশাল, ঢাকা, ফরিদপুর, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে বিশেষ ফসলহানি হয়নি। ফলে এখানে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ তেমন একটা ছিল না। তাছাড়া ‘নাজাই’ প্রথার প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কৃষকেরা ভিটে মাটি ছেড়ে পালায়। ‘নাজাই’ প্রথার অর্থ ছিল, কোন একজন রাজস্ব বাকী ফেললে সেই গ্রামের অন্য কৃষকদের সেই রাজস্ব দিতে হতো। এই বিশেষ কারণে মন্বন্তরের ফলে বহু কৃষক মারা যাওয়ায় তাদের বকেয়া রাজস্বের দায়িত্ব জীবিত কৃষকদের উপর বর্তায়। এই চাপ বহন করতে না পেরে বহু কৃষক জমির স্বত্ব ছেড়ে সরাসরি পাইকে পরিণত হয়।
সামগ্রিকভাবে কৃষির অবনতি ও অনাবৃষ্টির ফলে এই ভয়াবহ দুর্যোগ বাংলার জনজীবনকে গ্রাস করেছিল। এ সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষের চিহ্ন বাংলায় প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষের প্রাণহানির পর শেষ পর্যন্ত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটে। কোম্পানির রাজস্ব আহরণ থেকে আয়-কমে যায়। তাদের ব্যবসায় বাণিজ্যেও মন্দা দেখা দেয়। তাই কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি বাংলার কৃষি ও শিল্পকে বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নিতে দেখা যায় ইংল্যান্ডের কেন্দ্রিয় সরকারের পক্ষ থেকে। এজন্য ইংল্যান্ড থেকে দ্বৈত শাসন লোপ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। যার অংশ হিসেবে কোম্পানির রাজস্ব আহরণ ও শাসনের দায়িত্ব প্রত্যাহার করে নিতে ওয়ারেন হেস্টিংসকে নির্দেশ দেওয়া হয়। অবশেষে নানা কুফল যাচাই করে ১৭৭২ সালে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়।