চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

১৭৮৬ খ্রি. লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়ে আসেন। কর্নওয়ালিস ছিলেন একজন সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ এবং অত্যন্ত ক্ষমতাশালী গভর্নর জেনারেল। বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে বিভিন্ন রকম সংস্কার কাজের জন্যে তিনি একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। ভূমি ব্যবস্থায় তিনি যে যুগান্তকারী পরিবর্তন করেন তা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে।

স্মরণাতীত কাল থেকে বাংলা তথা ভারতে কৃষিজাত শস্যের একটি অংশ ভূমি রাজস্ব হিসেবে রাজকোষে জমা দেয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। এটি আদায়ের নানা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে রাজ কর্মচারীরা সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে আদায় করতেন। অনেকক্ষেত্রে মধ্যবর্তী কেউ এটি আদায় করতেন। এরা ছিলেন জমিদার, জোতদার বা অন্য কোন উপাধিধারী মধ্যস্বত্বভোগী। এরা নির্দিষ্ট কমিশন পেতেন।

লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করেন। এই প্রথা কার্যত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার জমি মালিকদের (সকল শ্রেণীর জমিদার ও স্বতন্ত্র তালুকদারদের) মধ্যে সম্পাদিত একটি যুগান্তকারী চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় জমিদার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বে জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন।

১৭৭২ খ্রি. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজ হাতে বাংলার দেওয়ানি তুলে নেয়। তখন থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের জন্যে পাঁচ বছর মেয়াদে জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়। এই পাঁচসনা ইজারাদারী ব্যবস্থার মেয়াদ শেষ হবার আগেই গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস পরবর্তীকালে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন। তিনি প্রাদেশিক রাজস্ব কাউন্সিলগুলোকে নির্দেশ দেন যে, তারা যেন এই ব্যবস্থার সাফল্য-ব্যর্থতা যাচাই করে পরবর্তী বন্দোবস্ত কিরূপ হওয়া উচিত সে বিষয়ে তাদের মতামত পেশ করেন। দেখা যায় যে, প্রত্যেকটি প্রাদেশিক কাউন্সিল পাঁচসনা ইজারাদারী ব্যবস্থার বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন। তারা পরিস্কারভাবে বললেন, নিলাম পদ্ধতিতে খাজনা আদায়ে অনিশ্চয়তা থেকে যায়। তারা আরো বলেন, জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা প্রয়োজন এ কারণে যে, কোম্পানির পক্ষে সরাসরি রায়তদের কাছ থেকে রাজস্ব বা খাজনা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কারণ, এ কাজের জন্যে যে লোকবল এবং অর্থের প্রয়োজন তা কোম্পানির ছিল না। এই অবস্থায় লন্ডনে কোম্পানির পরিচালকমন্ডলীরা (Board of directors) সিদ্ধান্ত নেয় যে, “এমন একটি রাজস্ব নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যে নীতি হবে চিরস্থায়ী ব্রিটিশ জাতি এবং কোম্পানির স্বার্থের অনুকূল।” অর্থাৎ তারা বাংলা তথা সমগ্র ভারতে শাসক ইংরেজদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন।

এ রকম একটি পটভূমিতে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের নির্দেশ মাথায় নিয়ে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কর্নওয়ালিস ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজধানী কলিকাতায় এসে পৌঁছেন। তিনি এসেই কর্মকর্তাদের জরুরি নির্দেশ দেন যে, তারা যেন, ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত সরবরাহ করেন।

বাংলায় কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং অভিজ্ঞ ছিলেন জন শোর। তিনি ছিলেন রাজস্ব বিশেষজ্ঞ এবং ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সৎ। প্রথম দিকে তিনি চিরস্থায়ী ব্যবস্থার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কর্নওয়ালিস অভিজ্ঞ জন শোরের মতামত উপেক্ষা করে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি এজন্যে লন্ডনে কোম্পানির পরিচালকমন্ডলীর মতামত চাইলেন। কর্নওয়ালিসের প্রস্তাব
পরিচালকমন্ডলীর সভায় অনুমোদিত হয় এবং ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কলিকাতায় এসে পৌঁছায়।

ফলে দেখা যায় যে, কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানি তার বাৎসরিক রাজস্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিল। জমিদারগণ যখন দেখলো তারাই জমির প্রকৃত মালিক তখন তারা নিজেদের পাশাপাশি ভূমি এবং রায়ত (কৃষক) শ্রেণীর উন্নয়নের জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর ক্ষেত্রে জমিদাররা পৃষ্ঠপোষকতা দান করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল, ক্রমে এরাই ইংরেজদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও অনুগত শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল কুফল
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়েছিল ভূমি জরিপ না করেই। রাজস্ব বিশারদ জন শোর এজন্যে এ ব্যবস্থার বিরোধিতা করে যেসব বিপদের কথা বলেছিলেন, কিছুদিনের মধ্যে বাস্তবেও সেগুলো প্রতিফলিত হলো। একজন জমিদারের অধীনে কি পরিমাণ জমি চাষাবাদের যোগ্য অথবা নিষ্কর অথবা গো-চারণ ভূমি ছিল তা নির্ধারণ না করেই শুধুমাত্র নিলামের ভিত্তিতে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছিল। ফলে কোথাও রাজস্বের হার অত্যধিক হয়েছিল, আর কোথাও হয়েছিল অনেক কম। এই অবস্থায় একজন জমিদারের জমিদারীর প্রকৃত সীমা নির্ধারিত না হওয়ায় অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমা এবং নানা রকম অব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় রায়ত শ্রেণী জমিদারের অত্যাচারের শিকার হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার আর্থিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়লো। জমিদাররা পরিশ্রম না করে আরামপ্রিয় ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়লো। তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করা শুরু করলেন। তাদের অবর্তমানে নায়েব গোমস্তারা সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। এবং রায়তদের ওপর বিভিন্ন প্রচারের
নির্যাতন ও অত্যাচার শুরু করে। রায়ত শ্রেণী সব অধিকার হারিয়ে ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল।

সূর্যাস্ত আইন
নিয়মিত খাজনা আদায়ের জন্য লর্ড কর্নওয়ালিস সূর্যাস্ত আইন প্রণয়ন করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় কোম্পানির রাজস্ব একটি নির্দিষ দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে দিতে অসমর্থ হলে কোম্পানি জমিদারি নিলামে বিক্রি করতো। এটাই সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত ছিল।

Add a Comment