লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস

আঠার শতকের সত্তরের দশকে ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। ভারতে ব্রিটিশ শক্তির এই দুর্দিনে বুদ্ধিমান, উদ্যোগী, অভিজ্ঞ ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ইংরেজদের বিলীয়মান শক্তি ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেন। তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮৫পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

লর্ড ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈত-শাসন ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে বাংলার সমৃদ্ধির দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে নবাব পেয়েছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং কোম্পানী পেয়েছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এক্ষেত্রে সুফলের পরিবর্তে কুফল ছিল বস্তুত অস্বাভাবিক রকম বেশি। দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা এক অর্থে বাংলার মানুষের শান্তি, স্থিতি ও সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করেছিল। ফলে কোম্পানির সিদ্ধান্ত অনুসারে ওয়ারেন হেস্টিংস দায়িত্ব নেবার প্রথমেই (১৭৭২) দ্বৈত শাসন বিলুপ্ত করেন।

১৭৬৫ খ্রি. দিওয়ানী লাভের পর দিওয়ানী পরিচালনার আইনগত অধিকার ছিল কোম্পানির। কিন্তু বাংলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল নায়েব দেওয়ান মুহাম্মদ রেজা খানের ওপর এবং বিহারের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল নায়েব দেওয়ান সীতাব রায়ের ওপর। কোম্পানির ডাইরেক্টররা নায়েব ও দিওয়ানদের সততায় বিশ্বাস করতেন না এবং তাদের ধারণা হয়েছিল যে, এরা রাজস্ব আত্মসাৎ করে ফেলে। এজন্যে হেস্টিংস প্রচলিত ব্যবস্থার অবসান করে রেজা খান ও সীতাব রায়কে পদচ্যুত করেন। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে তাদের বিচারের আয়োজন করেন। তবে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হন।


ওয়ারেন হেস্টিংস মুঘল সম্রাটের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক ২৬লক্ষ টাকা কর প্রদান বন্ধ করে দেন। তিনি রাজকোষের অবস্থা উন্নতির জন্যে নবাবের বাৎসরিক ভাতা ৩২ লক্ষ থেকে অর্ধেকে নামিয়ে ১৬ লক্ষ টাকায় স্থির করেন। হেস্টিংসের উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার করা। সে উদ্দেশ্যেই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম রাজস্ব বোর্ড গঠন করেন। গভর্নর এবং তার কাউন্সিলের সদস্য নিয়ে রাজস্ব বোর্ড গঠন করা হয়। দিওয়ানী সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্ব এই বোর্ডের হাতে দেয়া হয়। রাজস্ব কোষাগারকে মুর্শিদাবাদ থেকে কলিকাতায় স্থানান্তর করা হয়।


হেস্টিংস রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্যে একটি ক্ষুদ্র ভ্রাম্যমান কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির সদস্যরা প্রত্যেক জেলায় উপস্থিত হয়ে জমিদারদের সাথে সরাসরি বন্দোবস্ত করতেন। জমিদারদের সাথে পাঁচ বছরের জন্যে পাঁচশালা বন্দোবস্ত করা হল। কোম্পানির রাজস্ব আদায়কারীকে বলা হতো সুপারভাইজার। হেস্টিংস তাদের নাম বদল করে তাদেরকে কালেক্টর নামকরণ করেন।


দ্বৈত শাসনের নানা কুফল এবং নির্যাতন ও নিপীড়নের কারনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রেগুলেটিং বা নিয়ামক আইন – ১৭৭৩ পাস করে। এ আইনে গভর্নরের পদকে গভর্নর জেনারেল করা হয়। সে অনুসারে ১৭৭৪ সালে কোম্পানি ওয়ারেন হেস্টিংস কে গভর্নর থেকে গভর্নর জেনারেলে পদন্নতি দেয়। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথম গভর্নর জেনারেল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট রেগুলেটিং অ্যাক্টের দোষত্রুটি দূর করে ১৭৮৪ সালে ভারত শাসন আইন পাশ করে। এ আইন পাশের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইলিয়াম পিট

তিনি প্রজা সাধারণের উপর জুলুম ও নির্যাতনের মাধ্যেমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। মহারাজা নন্দকুমারকে বিচারের নামে হত্যার অভিযোগ ছিল। ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন। ১৭৮৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং ভারতের অভিজাতবর্গের ওপর নির্যাতন করার অভিযোগ উঠে। এজন্যে তাঁকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইম্পীচ (বিচার) করে। দীর্ঘ বিচারের পর তিনি ১৭৯৫ সালে খালাস পান। ১৮১৪ সালে তিনি মন্ত্রণাপরিষদ সদস্য(Privy Councillor) হন। ১৮১৮ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস দায়িত্ব পালন করেন ১৭৭২ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত। এর পর এক বছরের জন্য গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। জন ম্যাক ফেরসন, ১ম ব্যরনেট । ১৭৮৬ সালে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন চার্লস কর্নওয়ালিস।

Add a Comment