সি চিন পিং দুনিয়া শাসন করতে চান**
|প্রথম আলো, ১৮ জুলাই ২০১৮
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
কেভিন রাড অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী
ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে এবং গত মাসে কানাডায় অনুষ্ঠিত জি৭-এর সম্মেলনে যখন পশ্চিমা দেশগুলো প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যে রেষারেষিতে ব্যস্ত, তখন চীন নানাভাবে তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে চলেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) গত মাসে তার পররাষ্ট্রসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আয়োজন করে। ২০১২ সালে সি চিন পিং দলের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। এই সম্মেলনে চীন এটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে বিশ্বের কোথায় তারা নিজেদের দেখতে চায়।
২০১৪ সালেও ঠিক একই ধরনের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সম্মেলনের মূল কথা ছিল ‘লুকিয়ে রাখো তোমার শক্তিকে, অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করো, কখনোই নেতৃত্ব নিয়ো না’। কিন্তু এবারকার সম্মেলনে তাঁর উল্টো কথাই বলা হয়েছে। সম্মেলনে চীনা নেতারা এই ঐকমত্যে পৌঁছান যে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং চীন এখন বিশ্বের অপরিহার্য অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
২০১৪ সালের পর থেকে চীন দক্ষিণ চীন সাগরে তার সামরিক অবস্থান প্রসারিত ও সংহত করেছে। দেশটি নতুন সিল্ক রোডের ধারণাটি গ্রহণ করেছে এবং এটি বহু ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পরিকাঠামো এবং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক উদ্যোগে পরিণত হয়, যা ইউরেশিয়া, আফ্রিকা এবং এর বাইরের আরও ৭৩টি দেশকে সংযুক্ত করেছে। এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের অনুকরণে প্রতিষ্ঠা করেছে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি)। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ সহায়তা করাই এই বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংকের উদ্দেশ্য।
চীন তার প্রভাববলয়ে থাকা পূর্ব এশিয়ায় কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি ২০১৫ সালে ইরানের পারমাণবিক চুক্তির মতো উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। দেশটি শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও জিবুতিতে নৌঘাঁটি গড়ে তুলেছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে ভূমধ্যসাগর ও বাল্টিকে নৌমহড়ায় অংশ নিয়েছে। গত মার্চ মাসে, চীন তার নিজস্ব আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।
২০১৪ সালের পর থেকেই যে কেবল চীনে এই পরিবর্তন হচ্ছে বিষয়টা তা নয়। এর আগেও ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি চীনের উন্নয়নে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে। সি যখন লক্ষ করলেন যে দেশের বড় বড় নীতির বিতর্কে তাঁর দলের ভূমিকা গৌণ হয়ে আসছে, তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় দলের নিয়ন্ত্রণ ফের প্রতিষ্ঠা করলেন এবং প্রযুক্তিগত নীতিমালার ওপর তার রাজনৈতিক আদর্শকে অগ্রাধিকার দিলেন। সি চিন পিং উদার গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের ওপর বিজয়ী হতে চান এবং তাঁর এই চিন্তাধারা যা ‘সি চিন পিং থট’ নামে পরিচিত। এ জন্য তিনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সির ভাষায়, আধুনিক যুগের মধ্যে চীন এখন সবচেয়ে ভালো সময় কাটাচ্ছে, যখন গোটা বিশ্বে এক শতাব্দী ধরে অভূতপূর্ব পরিবর্তন চলছে। অবশ্যই চীনের সামনে অনেক বড় বড় বাধা রয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের সামনে এর চেয়ে বড় বাধা রয়েছে।
সিপিসির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে দেশের আন্তর্জাতিক নীতিসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সির মতাদর্শ অনুযায়ী কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। চীনের কূটনীতিকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে তাঁরা সিপিসির ক্যাডার। এ থেকে ধারণা করা হয় যে সি সম্ভবত বৈদেশিক নীতিকে বিশ্বজুড়ে তাঁর আধিপত্য বিস্তারের কাজে লাগাবেন। সিপিসির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সি বলেছেন, ‘চীনের প্রতি এখন আমার আহ্বান হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শাসনপদ্ধতির সংস্কারে নেতৃত্ব দাও।’ এটা চীনের অভিপ্রায়ের ব্যাপারে এ পর্যন্ত দেওয়া সবচেয়ে প্রত্যক্ষ বিবৃতি। এখন বিশ্বের উচিত চীনের আন্তর্জাতিক নীতির নতুন ঢেউয়ের জন্য প্রস্তুত থাকা। সি চিন পিং মনে করিয়ে দেন যে চীনের নীতি পরিচালিত হবে জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে।
বাকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো তারা এখন কী ধরনের বিশ্ব চায়, তা নির্ধারণ করা। ঠিক করতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অ্যাসোসিয়েশন বা আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যতের জন্য কী আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক পদ্ধতি চায়। অথবা আমেরিকা ঠিক কী চায়, ট্রাম্পকে নিয়ে বা ট্রাম্পকে বাদ দিয়ে? এবং কীভাবে তারা যৌথভাবে জাতিসংঘের চার্টার এবং মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের মধ্যে বিদ্যমান বৈশ্বিক মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণ করবে? ভবিষ্যতের জন্য চীনের কাছে স্পষ্ট পাণ্ডুলিপি আছে। এখন বাকি সব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভাবতে হবে তারা কী করবে।