উন্নয়নশীল দেশ- বাংলাদেশ

যে কারণে আমরা পিছিয়ে আছি
প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০১৮
ড. মইনুল ইসলাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক


গত ১৬ মার্চ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে, বাংলাদেশ যেহেতু স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উত্তরণের তিন পূর্বশর্ত পূরণ করেছে, তাই ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ পর্ব শুরু হলো। এ উত্তরণ পর্ব ছয় বছর মনিটর করার পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। ২০২৭ সাল থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সব নিয়মকানুনের আওতায় আসবে।

জাতিসংঘ এ স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের ক্যাটাগরির প্রচলন করেছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশকে এই ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রত্যাশায়, যদিও সাত কোটি জনসংখ্যার কোনো দেশকে সাধারণত এই ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম ছিল না। এই ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্তির পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী সংকটজনক অর্থনৈতিক অবস্থা কাটিয়ে উঠে এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সক্ষম হবে। এক দশক দূরের কথা, এ উত্তরণে ৪৩ বছর লেগে গেল। আমার বিশ্বাস, দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের কারণেই এ বিলম্ব।

বিশ্বের ‘ভিক্ষুকদের ক্লাব’ হিসেবে পরিচিত স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতে ঘানা, ভিয়েতনাম ও জিম্বাবুয়ের মতো কিছু দেশ কখনোই রাজি হয়নি তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় থাকা সত্ত্বেও। ভিয়েতনামের নজিরটি দেখুন: দুই দশকের ভয়াবহ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে ভিয়েতনামের যাত্রা শুরু ১৯৭৫ সালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের চার বছর পর। মার্কিনরা ভিয়েতনামকে আক্ষরিক অর্থে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এর আগে ভিয়েতনামকে ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে নামতে বাধ্য করেছিল ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স। কিন্তু ১৯৫৪ সালে দিয়েন বিয়েন ফুতে ফ্রান্সকে পরাজিত করেও আবার মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হতে হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামকে। তারা মার্কিনদের পলায়নে বাধ্য করেছিল ১৯৭৫ সালে। বিশ্বের দু-দুটো প্রবল পরাক্রান্ত সুপারপাওয়ারকে পরাজিত করেছে ভিয়েতনাম।

‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’-সুকান্তের এ অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য ভিয়েতনামের জনগণের ক্ষেত্রে। ভিয়েতনাম কখনোই জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতে আবেদন করেনি। অথচ কী দারুণ কষ্টকর ছিল ১৯৭৫-পরবর্তী বছরগুলোতে ভিয়েতনামের জনগণের জীবন! ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৯৫ সালেও বাংলাদেশের চেয়ে কম ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের প্রকাশিত ইউএনডিপি, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে।

হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন আন্তর্জাতিক ঝুড়ি’ হতে যাচ্ছে। কিসিঞ্জারকে তাঁর হতাশাজনক ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য দোষ দেওয়া যাবে কি? কারণ, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের জন্য বছরে যে দেড় কোটি টন খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হতো, তার মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন উৎপাদন করার সামর্থ্য ছিল আমাদের। বাকি ৩৫-৪০ লাখ টন খাদ্যশস্য বিশ্বের কাছে ভিক্ষা চাইতে হতো, কারণ ওই ঘাটতি খাদ্যশস্য আমদানি করার সামর্থ্যও ছিল না আমাদের। ১৯৭২ সালে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক বাজার সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল। দেশের যত্সামান্য রপ্তানি আয় দিয়ে ওই সময় আমদানি ব্যয়ের ৩০ শতাংশও মেটানো যেত না।

১৯৭৩ সালে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে যখন আন্তর্জাতিক তেল-সংকট শুরু হলো, তখন দেশের অর্থনীতি বেসামাল হয়ে গেল। অথচ বঙ্গবন্ধুর সরকার যেহেতু দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর পছন্দসই সরকার ছিল না, তাই ওই সময় বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য-সহায়তা পায়নি। আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন শুরু হয়ে গেলেও সরকার দুর্নীতিবাজ নেতা-কর্মী, শ্রমিকনেতা, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানাগুলোর প্রশাসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ১৯৭৪ সালে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ উপেক্ষা করে কিউবার কাছে বাংলাদেশের পাটের বস্তা রপ্তানির অপরাধে কৈফিয়ত তলবের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্য সাহায্যের গম বহনকারী পাঁচটি জাহাজকে মার্কিন সরকারের আদেশে মাঝপথে যাত্রা স্থগিত করে বিভিন্ন দেশের বন্দরে নোঙর ফেলতে হয়েছিল।

আমরা জানি যে ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যাতে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। (দুর্ভিক্ষের একমাত্র কারণ ওই মার্কিন সিদ্ধান্ত ছিল না, কিন্তু জাহাজগুলো সময়মতো বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারলে এত মানুষকে হয়তো দুর্ভিক্ষে মরতে হতো না! ১৯৭৩ সাল থেকে খাদ্যদ্রব্যের নাটকীয় মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে ‘এনটাইটেলমেন্ট ফেইল্যুর’ বা খাদ্যদ্রব্যের ওপর প্রান্তিক জনগণের অধিকারহীনতা সৃষ্টি হয়েছিল, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সেটাকেই দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।)

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার পর রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ‘সাহায্য-ভিক্ষুক’ চরিত্রকে সাদরে আঁকড়ে ধরে। ১৯৯১ সালের পর নির্বাচিত সরকারগুলোও বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার লোভ সংবরণ করেনি। প্রকৃতপক্ষে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে নানা ধরনের রিলিফ, অনুদান এবং স্বল্প সুদের ঋণ (সফট লোন) পাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ায় বাংলাদেশের গত ৪৩ বছরের সরকারগুলোর কাছে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণকে আকর্ষণীয় মনে হয়নি।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাংলাদেশে বৈদেশিক অনুদান ও সহজ ঋণের (সফট লোন) বান ডেকেছিল। প্রফেসর রেহমান সোবহানের বিশ্বখ্যাত বই দ্য ক্রাইসিস অব এক্সটার্নাল ডিপেন্ডেন্স-এর নবম পৃষ্ঠার সারণিতে দাবি করা হয়েছে যে বৈদেশিক অনুদান ও ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাত হিসাবে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতার নজির। জিয়াউর রহমান গর্বভরে বলতেন, ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’। বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমানও বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান সংগ্রহে তাঁর সাফল্যকে ফলাও করে প্রচার করতেন। কেনাবেচার রাজনীতি ও আমলাদের খুশি রাখার জন্য বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়েছিল জিয়াউর রহমানকে, যদিও তিনি দুর্নীতি করতেন না বলা হয়! অতএব, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বৈদেশিক অনুদান ও রিলিফ চুরি যেভাবে বিস্তার লাভ করছিল, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈদেশিক সাহায্য লুণ্ঠন এবং রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করে।

এরশাদ বিএনপি আমলের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেই বিচারপতি সাত্তারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এমনকি কয়েক দিন সাইকেলে চড়ে তাঁর অফিসে যাওয়ার ছবিও আমাদের দেখতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু এই স্বৈরশাসক বাংলাদেশকে দুর্নীতির লীলাক্ষেত্রে পরিণত করায় তাঁর শাসনামল থেকে বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থাকে ‘চৌর্যতন্ত্র’ (ক্লেপটোক্র্যাসি) আখ্যায়িত করা হয়। এই চৌর্যতন্ত্র শক্তিশালী হতে হতে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ’ অর্জন করেছিল।

আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে এখন সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচার। এতত্সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণ মাতৃভূমির এ লজ্জাজনক পরিচয় মুছে ফেলার জন্য দেশে-বিদেশে জীবনপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলে ৪৩ বছর পর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ। সত্তর ও আশির দশকের ভিক্ষুকের অবস্থা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অগ্রযাত্রায় প্রধান ভূমিকা পালন করে চলেছে কৃষি খাত, রপ্তানি খাত, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাত।

দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের কারণে বহুল বিলম্বিত এ অগ্রযাত্রাকে টেকসই করার সংগ্রামে এখন জাতিকে এগিয়ে যেতে হবে।


👉 Read More...👇

Add a Comment