উন্নয়নে রেমিট্যান্স এবং বিনিয়োগের গুরুত্ব****
|মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে অবস্থান করলেও সে একই পৃথিবীর মানুষ। মানুষ হিসেবে সে অধিকার, ধর্ম-বর্ণ বা জাতীয়তার কারণে বৈষম্যের শিকার হতে পারে না। কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীব্যাপী জাতিসংঘের কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভিবাসন ইস্যু। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি বৃহৎ অংশ আসে পোশাক খাত থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এ দেশের তৈরি পোশাকের বিপুল চাহিদা রয়েছে। কোটামুক্ত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ সংস্থাপন। সে কারণেই আমাদের দেশে পোশাক খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের জয়েন্ট ভেঞ্চারের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। কৃষি দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ এবং শ্রমশক্তির ৫৫ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে কৃষিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক এবং একটি সম্ভাবনাময় বৃহৎ বাজার। কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় উপখাত হলো শস্য খাত, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৬৯.৫৬ শতাংশ জোগান দেয়। বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এক বিপুল সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের উন্নতির জন্য দর্শনীয় বস্তুর অভাব নেই। এ দেশে বিরাজমান প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি যুগে যুগে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন দেশে পর্যটন খাতে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো, উন্নত করা হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা।
প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় বহু পর্যটক ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করে বাংলাদেশে না এসে চলে যান ভুটান কিংবা নেপালে। সরকার পর্যটনকে শিল্প খাতের মর্যাদা দিয়ে এক অধিকারপ্রাপ্ত খাতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে এ খাত বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনার খাতে পরিণত হয়েছে।
রেমিট্যান্স এবং বিদেশি বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাদের উন্নতির পেছনে অন্যতম কারণ বিদেশি বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ একে অন্যের পরিপূরক। বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করেছে চীন ও ভারত। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অবশ্যই এটা আশাব্যঞ্জক একটা দিক। ক্রমাগত উন্নয়নের পথে চলমান বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে। এই দেশে বিনিয়োগে মুনাফার পরিমাণ অনেক বেশি। একই সঙ্গে ঝুঁকি প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের ভূগর্ভে রয়েছে তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুদ। পেট্রোবাংলার দেওয়া তথ্যমতে, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ রয়েছে আট ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। বর্তমানে বার্ষিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এই গ্যাস দিয়ে চলবে আট থেকে নয় বছর। তবে দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রে সম্ভাব্য মোট মজুদের পরিমাণ ২৭ দশমিক ১২ টিসিএফ গ্যাস। এর মধ্যে প্রায় ১৪ টিসিএফ গ্যাস তোলা হয়েছে। ১৩ টিসিএফ গ্যাস এখনো মজুদ আছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেছে। সাগর ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়া স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানি কিংবা যৌথ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের সুপারিশের ভিত্তি করে বিদেশি দক্ষ পেশাজীবীদের ওয়ার্ক পারমিট প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। বাংলাদেশে কোনো ভারী শিল্পে কিংবা দীর্ঘমেয়াদে কোনো শিল্পে বা ব্যবসায়ে কমপক্ষে দশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছেন এরূপ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অব্যাহত আছে মর্মে বোর্ড বা বেজা কর্তৃক প্রত্যয়ন সাপেক্ষে বিদেশি বিনিয়োগকারীর বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদেয় নো ভিসা রিকুয়ার্ড সুবিধা অব্যাহত থাকবে। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্প খাতগুলোয় বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ করে হস্ত, ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পে বিনিয়োগকারীকে বিসিক শিল্পনগরীতে বা অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে। সৌরশক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, বায়ুকলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, বায়োমাস, গৃহস্থালি বর্জ্য ও শিল্প বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ইত্যাদিসহ সব ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্থাপনে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক নীতিগুলোর ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত সুনির্দিষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করেছে। নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধকে ন্যূনতম একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। সরকার সুষম গতিতে বাণিজ্যক্ষেত্রে উদারীকরণ করেছে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা, যৌক্তিক শুল্ক নির্ধারণ এবং রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন সাধিত হয়েছে। শিল্প হার কাঠামো ও আমদানি নীতির বিভিন্ন দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের জন্য রেমিট্যান্সের গুরুত্বও অত্যন্ত বেশি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে গেছে। যে কারণে আমাদের প্রবাসীদের উপার্জনও কম হচ্ছে। আমাদের প্রবাসীদের একটা বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যে থাকে। ব্যাংকের বেশি সার্ভিস চার্জ এড়ানোর জন্য এখন হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে টাকা দেশে পাঠানো হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। রেমিট্যান্সের ওপর আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের সার্বিক ব্যয় নির্বাহ হয়ে থাকে। ২০১৭ সালের ১৪ জুন প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য রেমিট্যান্স সেবার মান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনে নিয়োজিত সব অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের শাখাগুলোর জন্য বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিটি শাখায় রেমিট্যান্স হেল্প ডেস্ক চালু করতে হবে।
আমাদের প্রবাসী কর্মীরা অনেকেই লেখাপড়া জানে না। যদি অর্থ প্রেরণের জন্য ব্যাংকিং প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ না হয়, তবে অনেকেই ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আইএলওর মতে, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান, তার ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাকি ৬০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ আসে সরাসরি প্রবাসী বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে। আর বাকি ৩০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। এখন প্রয়োজন ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারণ। রেমিট্যান্স সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনে নিয়োজিত সব অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত সার্কুলারের সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
এ ছাড়া রেমিট্যান্স প্রেরণের সার্ভিস চার্জ অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। কারণ বহির্বিশ্বে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয় অনেক কমে গেছে। সার্ভিস চার্জ এড়ানোর জন্যও অনেকে এখন হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করছে। আর হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে না। বিদেশে যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেখানে ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগ এখানে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। অদক্ষ কোনো ব্যক্তির প্রবাসে যাওয়ার দরকার নেই। কারিগরি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর বিদেশে যেতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
জুলাই ২১, ২০১৮; আমাদের সময়
সংগ্রহ: মেহেদী হাসান জিম(Zakir’s BCS Specials)