নকশী কাঁথার মাঠ

গ্রন্থের নামঃ নকশী কাঁথার মাঠ
কবিঃ পল্লীকবি জসীম উদ্ দীন
চরিত্রঃ রূপাই, সাজু।

নকশী কাঁথার মাঠ-এর নায়ক রূপাই গাঁয়ের ছেলে, কৃষ্ণকায়, কাঁধ পর্যন্ত চুল। তার কতগুলো গুণ আছে : সে ভালো ঘর ছাইতে জানে, যে হাত দিয়ে সে সুন্দর ঘর ছায়, সেই হাতেই লড়কি চালাতে জানে, সড়কি চালাতে জানে, আবার বাঁশের বাঁশিতে তার মতো আড় আর কেউ দিতে পারে না, এমনকি তার মতো আর কেউ গান গাইতেও পারে না। এই রূপাইয়ের সঙ্গে পাশের গ্রামের মেয়ে সাজুর ভালোবাসা হয়, আর তারপর হয় বিয়ে। তারা সুখের সংসার পাতে। একদিন গভীর রাতে চাঁদ ওঠে, গোবর নিকানো আঙিনায় মাদুর পেতে সাজু রূপাইয়ের কোলে শুয়ে রয়, তাই একসময় বাঁশির বাজনা থেমে যায়। কারণ যাকে শোনানোর জন্য রূপাই এতদিন বাঁশি বাজিয়েছে, সেই মানুষটি এখন তারই ঘরে। সেদিন রাতের পূর্ণিমার আলোতে সাজুর রূপ দেখে দারুণ মুগ্ধ হয় রূপাই, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে কী যেন এক সংশয় জেগে ওঠে। সে ভাবে, এত সুখ আমার সইবে তো! এক অজানা আশঙ্কায় তার অন্তরের বেদনাশ্রু সাজুর কোমল মুখের ওপর পড়ে, সাজুর ঘুম ভেঙে যায়, স্বামীর চোখে জলের ধারা দেখে সাজু বলে, তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে তো আমি কোনো আঘাত দিইনি। রূপাই বলে, এক অজানা আশঙ্কায় কাঁদছি। সাজু বলে, না না, আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি। এমন সময় হঠাৎ খবর আসে, বনগেঁয়োরা তাদের গাজনা-চরের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। রূপাই ছুটে যায় লড়কি-সড়কি হাতে বনগেঁয়োদের প্রতিরোধ করতে। সেখানে লড়াই হয় (স্থানীয় ভাষায় কাইজ্জা), কয়েকটি খুন হয় এবং ফলশ্রুতিতে রূপাই ফেরারি হয়ে যায়। আর সাজু রোজ একটা পিদিম বা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকে রূপাইয়ের পথ চেয়ে। একটা মরা পাতা ঝরে পড়লেও রূপাই-বিরহিণী সাজু, পাতার শব্দ লক্ষ করে আলোটা নিয়ে ছুটে যায়, কোথায় রূপাই? দিন চলে যায়। একদিন গভীর রাতে রূপাই এসে দাঁড়ায় সাজুর সামনে। সাজু দেখে, রূপাইয়ের সারা গায়ে মাটি মাখা, রক্তের দাগও লেগে আছে কোথাও কোথাও। সাজু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোমাকে আর যেতে দেবো না।’ রূপাই বলেছে, ‘আমার না যেয়ে উপায় নেই, যেতেই হবে। কেননা, আমি যদি ধরা পড়ি, আমার ফাঁসি অথবা কালাপানি হবে।’ সাজু এখানে বলেছিল, ‘তুমি তো চলে যাবে আমাকে কার কাছে তুমি রেখে যাবে’, তখন রূপাই বলে,

সখী দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই।
মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে
তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণতলে।

ইহলোকে রূপাইয়ের সঙ্গে সাজুর এই ছিল শেষ দেখা। সাজু আর কী করবে, সেই প্রথম দেখা ও বৃষ্টির জন্য কুলা নামানোর দিনের দৃষ্টি বিনিময় থেকে শুরু করে তাদের জীবনের সব কথাকে এমনকি যে রাতে রূপাই জন্মের মতো চলে গেল, এসব অতীত স্মৃতি কাঁথার ওপর ফুটিয়ে তুলতে লাগলো সুঁই-সুতা দিয়ে। যেদিন সেই কাঁথা বোনা শেষ হয়ে গেলো, সাজু তার মায়ের কাছে দিয়ে বললো, ‘মা, আমার মরণের পরে যেখানে কবর দেওয়া হবে, সেই কবরের ওপরে যেন এই নকশী কাঁথাখানা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি কোনোদিন রূপাই এসে আমার খোঁজ করে, তাকে বোলো, তোমার আশায় সাজু ওই কবরের নিচে আছে।’
বহুদিন পরে গাঁয়ের কৃষকেরা গভীর রাতে বেদনার্ত এক বাঁশির সুর শুনতে পায়, আর ভোরে সবাই এসে দেখে, সাজুর কবরের পাশে এক ভিনদেশি লোক মরে পড়ে আছে। কবি জসীমউদ্দীন এই আখ্যানের একেবারে শেষ পর্বে এর করুণ বেদনাকে প্রকাশ করতে লিখেছেন:

আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে
নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।

শুধু তা-ই নয়, তিনি এ কাহিনীর বেদনাকে বিস্তার করে দিতে আরও লিখেছেন,

কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে
মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকসী কাঁথাটি ধরে
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ওগাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।

  • কবি জসীম উদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে লিখুন। (৩৮তম বিসিএস লিখিত)

Add a Comment