কৃতদাসের হাসি

‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের রূপকাৰ্থ ব্যাখ্যা করুন। (৩৭তম বিসিএস লিখিত)

ক্রীতদাসের হাসি বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত একটি উপন্যাস। ১৯৬২ সালে তিনি এ উপন্যাসটি রচনা করেন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানকে বর্বর স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে আবদ্ধ করলো। এ সময় সব ধরনের-বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্থানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে এ উপন্যাস রচিত হয়। এ উপন্যাসের মূল চরিত্র তাতারী। গণতান্ত্রিক চেতনাকে ভয় পায় স্বৈরাচারী শাসক। এই চেতনাকে দমন করার জন্যই আবার নেমে আসে সামরিক শাসন তবুও লেখকের প্রতিবাদ স্তব্ধ থাকেনি। রূপকের মধ্য দিয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে এই প্রতিবাদ। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র তাতারী। খলিফা হারুনর রশীদ কোনো কিছুর বিনিময়েই তাতারীর হাসি শুনতে পান না। খলিফার নির্দেশে হাসার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছে তাতারী।


পৃথিবী শুধু তার জন্য যার ক্ষমতা আছে। এখানে যে কেউ চাইলেই সুখে থাকতে পারে না, হাসতে পারে না, অধিকার নেই। হাসবে শুধু তারাই, যাদের ক্ষমতা আছে, বিত্ত-ভৈবব আছে। ইচ্ছামতো ভালো থাকার অধিকার, সুখে থাকার অধিকারও তাদের। শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি আমার এই কথাগুলোর ভিত্তি প্রস্তর দাঁড় করিয়েছে। বোঝার সুবিধার্থে উপন্যাসের কিছু ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
বাগদাদের অধিপতি হারুনর রশীদের মুখে আবেগ-চাঞ্চল্যের ছাপ। বড় একা লাগছে। সুসজ্জ্বিত মহল ‘কাওসুল আকদারে’ সবকিছুই আছে কিন্তু কেমন এক শূন্যতা ঘিরে আছে তার পুরো পৃথিবী জুড়ে। ভুলবশতঃ প্রিয় উজির আজম জাফর বামের্কীর কতল পরোয়ানা দিয়েছিলেন। নিজের করা ভুলে অনুশোচনায় ভুগছেন। মনের অশান্তি থেকে একটু পরিত্রান পেতে একান্ত সেনাপতি মশরুরের পরামর্শে বাগানে হাঁটতে বের হলেন। পুরানো স্মৃতি আওড়াতে লাগলেন বারবার। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন তার মহলের অদূরেই সুখের হাসি হাসছে কেউ। অস্পষ্ট তবে মোহনীয়, যুগযুগান্তের উৎসবের বার্তাও বয়ে আসে সেই হাসির তরঙ্গে।
বাদশাহের অশান্ত মন আরো বেশী অশান্ত হয়ে উঠে। বাগদাদ অধীশ্বর হয়েও তিনি যে শান্তির গরীবানা হালে আছেন তা তো এই কথাগুলোতেই ফুটে উঠেছে- “মশরুর। শুনেছো এমন হাসি? এতরাতে কে হাসছে আমার মহলের দেওয়ালের ওদিকে? এ হাসি ঠোঁট থেকে উৎসারিত হয়না। এর উৎস সুখ-ডগমগ হৃদয়ের নিভৃত প্রদেশ। ঝর্ণা যেমন নির্জন পাহাড়ের উৎসঙ্গ-দেশ থেকে বেরিয়ে আসে উপলবিনুনী পাশে ঠেলে ঠেলে-বিজন পথ-ভ্রষ্ট তৃষ্ণার্ত পথিককে সঙ্গীতে আমন্ত্রণ দিতে-এই হাসি তেমনই বক্ষঝর্ণা-উৎসারিত। কিন্তু কে এই সুখীজন- আমার হিংসা হয়, মশরুর। আমি বাগদাদ অধীশ্বর সুখ ভিক্ষুক। সে তো আমার তুলনায় আরোও বড় ভিক্ষুক, তবু সুখের অধীশ্বর! কে, সে?
যখন জানা গেল এ হাসি তারই গোলামের তখন তিনি অবাক না হয়ে পারলেন না। গোলামেরা এমন হাসি হাসতে পারে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। জোর যার মুল্লুক তার সূত্রে হারুনর রশীদের মুল্লুক আছে ঠিকই কিন্তু হাসি নেই। গোলামের মুল্লুক নেই তবে সুখের সমৃদ্ধি আছে, হৃদয়ের কোঠরে হাসি আছে। আর কি চাই?
হাবসী গোলাম তাতারীর সাথে বাদশাহের সহধর্মিণী জুবায়দার একান্ত বাঁদী আরমেনী তরুণী মেহেরজানের গোপন বিয়ে হয়েছিল। এই বিয়ের দায়িত্ব পালন করেন স্বয়ং বাদশাহের সহধর্মিণী। মেহেরজান খুবই রুপবতী, আকর্ষণীয়া যৌবনবতী এক নারী। বেগম জুবায়দা মেহেরজানকে খুব ভালোবাসতেন, হাসি-তামাশা করতেন তার সঙ্গে। বেগম জুবায়দার উৎসাহে প্রতিরাতেই তাতারীর সাথে গোপন অভিসারে যেত মেহেরজান, সুখে-শান্তিতে কাটতে থাকে এই দুই প্রেমিকযুগলের। তাদের সুখী জীবনের বার্তাই গভীর রাতের নিঃস্তব্ধতাকে ম্লাণ করে দিয়ে হাসি হয়ে ভেসে বেড়ায় দূর থেকে দূরে।
ঘটনাক্রমে গোলামের সুখের রহস্য জানতে পারলেন বাদশাহ। পরিকল্পনামতো একরাতে হাজির হলেন তাতারীর শয়নকক্ষে, একসাথে পেয়ে গেলেন মেহেরজানকেও। অতুলনীয় রুপবতী, যৌবনা মেহেরজানকে দেখলে যেকেউ ভালোবেসে ফেলবে। বাদশাহও মুগ্ধ হলেন এই অপরুপ লাবণ্যময়ীকে দেখে। ভীত-সন্ত্রস্ত তাতারী ও মেহেরজানকে বাদশাহ অভয় জানালেন এবং তাদেরকে তখনই আজাদ ঘোষণা করলেন। শাস্তির বদলে অভাবনীয় পুরস্কারে দু’জনই অবাক হলো। বাদশাহ জানালেন তাদের হাসিই তাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এবং হাসিতে মুগ্ধ হয়েই এই এনাম তাদেরকে দেয়া হয়েছে। তাতারীকে একটি রাজ্যের রাজত্ব ঘোষণা করা হলো। রাতের দিপ্রহরে যে তাতারী ফকির ছিল ত্রিপ্রহরে এসে সে আমির হয়ে গেল। হাসির এত শক্তি, এত দাম! তাতারীকে তখনই তার জন্য মনোনীত রাজ্যে পাঠিয়ে দেয়া হলো, এবং বলে দেয়া হলো অতিশীঘ্রই তার হাসি শুনতে যাবেন বাদশাহ। মেহেরজানকে বেগম জুবায়দার কাছে ফিরে যেতে বলা হলো।

উপন্যাসের এই পর্যায়থেকে ঘটনা ভিন্নরুপ নিতে শুরু করে। তাতারী তার নতুন রাজ্যে বাস করা শুরু করলো কিন্তু তার সুখের পৃথিবীর দরজা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। তাতারীর সুখের ঠিকানা ছিল মেহেরজান। সারাদিনের ক্লান্তির পরে মেহেরজানকে কাছে পেয়ে সব কষ্ট ভুলে যেতে পারতো, মন খুলে হাসতে পারতো। কিন্তু এখন!
গোলামী জীবনে মেহেরজান ছিল, সুখের একটা ঠিকানা ছিল সেথায়। হৃদয়জুড়ে দুঃচিন্তার কালো মেঘ জড়ো হতে থাকে তাতারীর। অনিশ্চয়তার কালো ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে ক্রমশঃ। হাসতে ভুলে যায় তাতারী। বাদশাহ তাতারীর মনে শান্তি এনে দিতে বাগদাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সুন্দরী চিরযৌবনা তরুণীকে পাঠালেও তাতারী সেই রমণীকে ফিরিয়ে দেয়। তাতারীর নৈতিকতার জোর দেখে লজ্জায় পড়ে যায় সেই সুন্দরী এবং পড়ে সে অকল্পনীয়ভাবে আত্মহত্যা করে। রাজ্য-রাজত্ব, ভোগ-বিলাস কোন কিছুই চাইনা তাতারীর। কোনো কিছুতেই যে লোভ নেই চরিত্রবান হাবসী গোলাম তাতারীর। বাদশাহ অসন্তুষ্ট হয়ে যান এই যুবকের উপর। ঈর্ষান্বিত হন তাতারীর পবিত্র আত্মার জ্যোতি দেখে, তার প্রশংসা বিষিয়ে তোলে বাদশাহকে। নির্মম অত্যাচারের খরগ নেমে আসে তাতারীর ওপর।

বাদশাহের কারাগারে অত্যাচারে জর্জড়িত ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে তাতারী বেঁচে থাকে দীর্ঘ ৩/৪ টি বছর কিন্তু তার মুখে কোনো কথা নেই। এই দীর্ঘ কারাবাসে একটি কথাও বাদশাহের সাথে বিনিময় করেনি সে। শেষদৃশ্যে মেহেরজানের উপস্থিতি ঘটে বাদশাহের বিবি পরিচয়ে। কথা ফোটে তাতারীর মুখে। অসহ্য যন্ত্রনা সয়েও এতটুকু ভালবাসা কমে যায়নি মেহেরজানের প্রতি বরং মেহেরজানই ভুলে গিয়েছিল সবকিছু। শেষপর্যায়ে হলেও মেহেরজান চিনতে পারে তার ভালোবাসার যথাযোগ্য পুরুষ তাতারীকে। কিন্তু নিরুপায় মেহেরজান এবং তাতারী। তারা কি জানতো যে হাসির বিনিময়ে তারা মুক্তি পেয়েছিলো সেটা আসলে মুক্তি ছিলনা বরং তার চেয়ে আরও কঠিন শেকল তাদের পায়ে বেঁধে দেয়া হয়েছিল। ইতিহাসে দেখা যায় অধিকাংশ শাসকরা নিজেকে ঈশ্বরের মর্যাদা দান করে বসেন, প্রজারা তাদের হুকুমের গোলাম হয়ে থাকে সারাজীবন। উপন্যাসের ভীতরকার প্রতিটি ঘটনা পাঠকহৃদয়কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সমাজের ক্ষমতাশালীদের আধিপত্যের নোংরা আচরণগুলো।

ক্রীতদাসের হাসি শওকত ওসমানের জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালের দিকে। উপন্যাসটি রচনা সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য থেকে জানা যায় এটি আরব্য কাহিনী- ‘আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে’ (সহস্র দুই রাত্রি)’-র শেষ কাহিনীর বাংলা তরজমা (অনেকেই জানেন ‘আলেফ লায়লা লায়লান’ অর্থাৎ ‘সহস্র এক রাত্রি’ কিন্তু সেই তথ্যটি যে ভুল উপন্যাসটির ভূমিকা অংশে লেখক সে সম্পর্কে একটি আলোচনা তুলে ধরেছেন)। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কবলে তৎকালীন পাকিস্তানে জনগনের সবধরনের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। সেই শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে এই উপন্যাস জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বেশ।
গণতান্ত্রিক চেতনায় যখনই কেউ সোচ্চার হয়েছে তখনই স্বৈরশাসকরা তা কঠোর হাতে তা দমন করেছে। এবং এই প্রথা চলতে থাকে যুগ যুগ ধরে, প্রতিবাদ যে কেউ করে না, তা কিন্তু নয়। প্রতিবাদ করে, তবে তাতে লাভের লাভ হয়না কিছুই উল্টো প্রতিবাদকারীকে চরম মূল্য গুনতে হয় সবসময়ই। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের তাতারী গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করেছে। আর বাদশাহ হারুনুর রশীদ স্বৈরশাসকের ভূমিকা পালন করেছে যেন। এই ঘটনা রুপকের মধ্য দিয়েই বিস্তৃত হয়েছে শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি।

উপন্যাসের রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করতে যারা অনিচ্ছুক তাদের কাছেও গোলাম তাতারীর তীব্র শ্লেষমাখা চিৎকার বাঙালীর সংগ্রামের চেতনা পাঠকের কাছে সুস্পষ্টভাবে ধরা দিবে শেষ অংশের এই কথাগুলোই- ক্ষত-বিক্ষত তাতারীকে চাবুক মারা হচ্ছে, তাতারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে এবং বলছে- “শোন হারুনুর রশীদ, দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে, বান্দী কেনা সম্ভব! কিন্তু… কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি? না! না! না! না!

সংগ্রহঃ বিডি এসএফ বিডি, Howlader Alamin

One Comment

Add a Comment