আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে (কবিতা)

পটভূমিঃ নজরুল ইসলাম যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থটি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেছিলেন। এ নিয়ে কবিগুরুর ভক্তদের অনেকেই খুশি হতে পারেননি। অনেকেই ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন-

বসন্ত দিল রবি
তাই তো হয়েছে কবি।

তবে কাজী নজরুল ইসলাম এতে উল্লসিত হয়ে জেলখানায় বসেই লেখেন ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতা।

ভাবার্থঃ কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতার অন্যতম একটি হলো ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। কবিতাটি তাঁর ‘দোলন চাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এই কবিতায় কবির সৃষ্টি-সুখের আনন্দ অসাধারণ আবেগ ও উচ্ছ্বাসের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে। কবির ভাবনায়, বিশ্বাসে ও জাগতিক নিয়মে এতদিন যা ছিল রুদ্ধ তা যেন আজ শত ধারায় উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। সর্বত্রই এখন তিনি
অনুভব করেন সৃষ্টির কোলাহল, গতির উন্মাদনা, প্রাণের উচ্ছ্বাস আর মুক্তির আনন্দ। এই অফুরন্ত ভাবাবেগ ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি যে কাব্যভাষা প্রয়োগ করেছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে তা একান্তই নতুন ও প্রথাবিরোধী। এই কবিতার মধ্যে নজরুলের কাব্য প্রতিভার সকল মাত্রার আনন্দিত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।

শব্দার্থ ও টিকাঃ
উল্লাস – পরম আনন্দ, হৃষ্টতা;
সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে – আনন্দ সৃষ্টি করতে পারার পরম আনন্দ;

পল্বল – বিল, ক্ষুদ্র জলাশয়;
রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে – প্রাণে বন্ধ জলাশয়ে বা প্রাণ রূপ জলাশয়ে;

কল্লোল – জলস্রোতের কলকল শব্দ; রুদ্ধ প্রাণের কল্লোলে – প্রাণ রূপ জলাশয়ে দুয়ার ভাঙা ঢেউ বা তরঙ্গ জোয়ার এনেছে;

হুতাশ – অগ্নি, হুতাসন;

শ্বসল – নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করা; শ্বসল হুতাশ – অগ্নি নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করল-অর্থাৎ আগুন অতি তেজের সঙ্গে জ্বলে উঠল;

চক্র – চাকা; এখানে হিন্দু পুরাণমতে দেবতা বিষ্ণুর হাতে অন্যায় ধ্বংসকারী চাকাকে বোঝানো হয়েছে;

পিনাক – হিন্দু পুরাণ মতে দেবতা শিবের ধনু;
পিনাকপাণি – পিনাক(ধনু) পাণিতে (হাতে) যার, অর্থাৎ শিব।
পিনাকপাণির শূল -এখানে হিন্দু পুরাণমতে দেবতা শিবের হাতের ত্রিশূলকে বোঝানো হয়েছে।

ফাগুন – ফালগুন বা বসন্তকাল;

মদন – হিন্দু পুরাণমতে প্রেমের দেবতা;
মদন মারে খুন মাখা তূণ -প্রেমের দেবতা মানুষের হৃদয়ে তীর বিদ্ধ করেন বলে তা হৃদয়ের রক্ত মাখা বলে মনে করা হচ্ছে;

ঘায়েল – আহত, আঘাতপ্রাপ্ত। এখানে বসন্তকালের রঙে রঞ্জিত বোঝানো হয়েছে;
ফাগ – আবীর, নানা রঙের গুঁড়ো;
দিক-বাসে – দিগন্তরেখা রূপ বন বা বস্ত্রে;

পীত – হলুদ রং, হলদে;
দিগবালিকার পীতবাসে- দিগন্ত রূপ বালিকার হলুদ রঙের বস্ত্রে বা বসনে;

গাজন – (পুরাণমতে) চৈত্র মাসের শেষে (অর্থাৎ বসন্তকালে) দেবতা শিবকে নিয়ে গান;

আশিন – আশ্বিন মাস;
দুব – দূর্বা, এক রকমের ঘাস;
উছলে- উচ্ছলিত;
উজান – স্রোতের বিপরীত দিক;

ভৈরবী – শিব অনুসারী সন্ন্যাসিনী, ভয়ংকরী;
বিশ্বডুবাল …. গান ভাসে – স্রোতের বিপরীত দিক থেকে ঠেলে বিশ্ব ডোবানো ঝড় এসেছে, তার সঙ্গে তাণ্ডব নৃত্যকারী শিবের অনুসারী সন্ন্যাসিনীদের গান মিশেছে।

বল্গা হারা- লাগাম ছাড়া।

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন,
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে –
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ,
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,

আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ,
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;
আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
>আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর,
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে!
মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!

Add a Comment