কালো বরফ
|মাহমুদুল হকের শ্রেষ্ট সৃষ্টি ‘কালো বরফ’, কেন্দ্রীয় চরিত্র আব্দুল খালেক অর্থাৎ পোকা একজন ধোপদুরস্ত কলেজ শিক্ষক, মফঃস্বলের জীবন সংগ্রাম তার কাছে খানিক সহনীয় পর্যায়ে গেলেও বেসরকারী কলেজের চাকরি, যে কলেজের এফিলিয়েশনের সম্ভাবনা না থাকায়, বন্ধ হওয়ার উপক্রম, যারপরনেই জীবন যে কোথায় এসে থমকে গেছে, সামনে-পেছনে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো কোন পরিবেশ পায় না, তারপর নিজেকে শান্ত নির্জীব রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। নয় বছরের দাম্পত্য জীবনে এক ছেলের জনক আব্দুল খালেকের আর্থিক অবস্থা নাজুক বা পর্যুদস্ত, স্ত্রী রেখাকে নিয়ে ছোট্ট একটা সংসার, কিন্তু দারিদ্র্যতা তাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে বলেই সামনে চলতে পারে না, পেছন থেকে বাধার একটা লম্বা প্রাচীর দৃশ্যমান হয়, অথচ নতুন কাজের ব্যাপারে বা টাকা রোজগারের কোন সম্ভাবনায় তার মধ্যে বিন্দুমাত্র লক্ষ্য করা যায় না এবং সে কারণে সমস্যা আরও ঘণায়িত হয় প্রাত্যহিক জীবনে। শৈশবের ভাবনা বা স্মৃতি তাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করে ফলে সে বর্তমান জীবন থেকে নির্লিপ্ত এবং নিস্পৃহতার মধ্যে বসবাস, আবদুল খালেক চরিত্রটি সে কারণে স্বাতন্ত্রতার দাবি রাখে, নস্টালজিয়া আক্রান্ত একজন মানুষ শৈশবের স্মৃতির মধ্যে ডুবে থাকতে চায় এবং সেখানেই সে চরম সান্ত¦না খোঁজে, বাড়তি আয় বা আগামী জীবনের স্বপ্ন তার কাছে ফালতু বিষয় বলে মনে হয়, উপন্যাসে নস্টালজিয়ার আবেগ চরমভাবে জড়িয়ে আছে, কাহিনীর আখ্যান নির্মিত হয়েছে শৈশব স্মৃতি নিয়ে, ১৯৪৭ এর ভারতবর্ষ বা বাংলাবিভাজন যে দুটো দেশের জন্ম, তারই অংশ পূর্ববাংলা খালেকের বর্তমান আশ্রয় হলেও সে আশ্রয়ও তাকে স্বস্ত দিতে পারে না, পোকার মন-প্রাণ সুদূর অতীত পড়ে থাকে, নিজের জীবনটাকে কোন ছঁকে ফেলতে পারে না, হতাশানিমজ্জিত মানুষ সামনে যাওয়ার চেয়ে পেছনেই বেশি হাঁটতে জানে। কালো বরফের ভেতর দিয়ে মাহমুদুল হক দেশভাগের চরম কষ্টের গল্প শুনিয়েছেন, মানুষের একবার অস্তিত্বের বিপর্যয় হলে আর ঠেকানো সম্ভব হয় না, সে তখন পাখি হয়ে যায়, আর পাখির মতো এদেশ-ওদেশ ঘুরে মরে, অথচ কোথাও তার আশ্রয় চিরস্থায়ী হয় না। দেশভাগ মানুষের স্বপ্নের মধ্যেও ভাঙ্গা বেদনা ফুটে ওঠে, হয়তো সে বেদনা সবার মর্মস্থলে সেভাবে নাও পৌঁছাতে পারে, অথবা পৌঁছালেও সেভাবে সে উপলব্ধি করতে পারে না, কিন্তু একটা প্রগাঢ় ধাক্কা তাকে চিরকালের মতো অসার করে দেয়, পোকার জীবনটাতে নস্টালজিয়া ভর করে, সে যেন কিছুই করতে পারে না, সবখানে সে নিজে অযোগ্য বা অদক্ষ ভেবে নিরাশ হয়।
মাহমুদুল হক ‘কালো বরফ’-এ দেশভাগের মর্মবেদনার ইতিহাস পাঠককে হতবাক করে দেয়, খালেকের জীবন তছনছ হয়ে যায়, প্লট নির্মাণের ক্ষেত্রে গ্রহণ-বর্জনের যে সূক্ষ্ন মানদন্ড নিয়ে একজন সাহিত্যিককে এগিয়ে যেতে হয়, সেখানে পরিমিতি জ্ঞানের ঘাটতি থাকলে আখ্যানটি সুগ্রন্থিত হতে পারে না, কিন্তু এখানে কাহিনীমালায় মাহমুদুল হক তার ঔপন্যাসিকসুলভ সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি চমংকার উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন, ‘কালোবরফ’-এ কারণে মাহমুদুল হকের শুধু শ্রেষ্ঠ উপন্যাস নয়, বাংলা সাহিত্যের একটা শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। দাম্পত্য কলহ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও সাহিত্যিক একে স্বাভাবিক কলহে পরিণত করেননি, কবি জীবনানন্দ দাশের গল্প-উপন্যাসেও দাম্পত্য কলহ বিরাজমান হলেও নায়কের যে নিস্ক্রিয়তা বা কলহের বিপরীতে অবস্থান, সেখান থেকে খালেকের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মিল পাওয়া যায়, মাকে কাছে রাখার যে বাসনা খালেকের ছিল কিন্তু স্ত্রী রেখার কারণে তা সম্ভবপর হয়নি, সে মনোকষ্টে দগ্ধ হলেও কিছুই সে বলতে পারেনি, সে যন্ত্রণা কতখানি তা পাঠক অনুধাবন করতে পারে সহজে। মা-ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন দেশ-মাটি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন একটা মানুষ চিরজীবন নিঃসঙ্গতার মধ্যে কাটালেও, স্ত্রী-পুত্রের সান্নিধ্যে কখনও তার একাকিত্ববোধ দূর করতে পারে না। একটা কিসের অভাববোধ তাকে অহর্নিশি সর্বদা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, মাহমুদুল হক এভাবেই কালো বরফের তাৎপর্য তার অভিরুচি তার সৌন্দর্যবোধ সাহিত্যের আঙিনায় ছড়িয়ে দিয়েছেন।
অনুরূপভাবে হাসান আজিজুল হক ‘ আগুনপাখি’তে এক মধ্যবয়সী নারীর দেশভাঙ্গার মতো মর্মস্পর্শি কান্না শুনতে পাওয়া যায়।
আবার শওকত আলী ‘ওয়ারিশ’ এর দেখা যায় দেশভাগের মর্মবেদনা, অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মানুষকে তার অস্তিত্বের শেকড়কে অস্বীকার করে পালিয়ে আসতে হয়, সময় মানুষকে এভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কেউ কি কখনো তার শেকড় ছিঁড়ে ফেলে, অথচ চেনা মানুষ যখন আর চেনা থাকে না, অদ্ভুত এব আঁধার নামে দুনিয়ায় তখন মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, মার খাওয়া মানুষের মতো মুর্শেদরা যেমন একদিন পালিয়ে আসে, পালিয়ে আসতে না চাইলেও কোন উপায়ই থাকে না, এভাবেই মানুষ নিজ ভূমি থেকে চিরকালের মতো উচ্ছেদ হয়ে ভুঁইফোঁড় হয়, উপন্যাসে দেখা যায় চার প্রজন্মকে, জওহর আলী থেকে শুরু মুর্শেদ, তারপর রায়হান এবং সর্বশেষ রঞ্জু। তিরিশ বছর আগের উকিল পাড়ার এই জায়গাটি, স্মৃতিমন্থন মানে শৈশব-বাল্য-কৈশোর জীবনের নানান টুকরো-টাকরা ছবি দৃশ্যপটে চলে আসে একে একে সেলুলয়েডের ফিতের মতো, ‘ওয়ারিশ’ আবহমানকালের দলিল, বাংলা বিভাজনের ফলে যে দুর্দশা যে অতুলনীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা অনুধাবন করার হিসেব-নিকেশ করলে বোঝা যায় যে, সে ক্ষতি পূরণ হবার নয়,