হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের লোক
|প্রথম আলো, ১৫ মে ২০১৮
ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইরফান হুসাইন: পাকিস্তানের সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে নড়চড় না হওয়া একটি বিষয়ও যদি থাকে, তাহলে সেটি হলো ইসরায়েলের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য পক্ষপাতমূলক সমর্থন। ট্রাম্পের পূর্বসূরিরা কয়েক দশক ধরে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণাকে কট্টরভাবে সমর্থন করে এসেছেন। তারপরও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে চক্ষুলজ্জার অংশ হিসেবে যতটুকু নিরপেক্ষতা এত দিন তাঁরা দেখিয়ে এসেছেন, ট্রাম্প সেটুকুকেও ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন।
ইসরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সময় ফ্রিডম্যানকে কতটা বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তা সিনেটের শুনানির দিকে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে। সিনেটে শুনানিতে তাঁর পক্ষে ভোট পড়েছিল ৫২ টি। বিপক্ষে পড়েছিল ৪৬ টি। সাধারণত, এই পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের এতটা বিরোধিতার মুখে পড়তে হয় না।
ফ্রিডম্যানকে নিয়োগ করার সময় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এবং ট্রাম্প মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর আব্বাস ফ্রিডম্যানকে ‘কুকুরের বাচ্চা’ (সান অব ডগ) বলে গালি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প তাতে কান দেননি। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলে থাকা স্তাবকদের খুশি করতে ট্রাম্প এগিয়ে যেতে থাকেন।
ট্রাম্প ইরানের ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপের নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি হুমকি দিয়েছেন, যেসব দেশ ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, তাদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। এর ফলে ইরানের সঙ্গে অন্যান্য দেশের কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা হুমকির মুখে পড়বে। ইউরোপীয় কোম্পানি এয়ারবাসের কাছ থেকে ইরানের তিন হাজার কোটি ডলারে বেসামরিক বিমান কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এই কেনাবেচা বন্ধ হতে পারে। এয়ারবাসের আশঙ্কা, তারা যদি ট্রাম্পের হুমকি না মেনে ইরানের কাছে বিমানগুলো সরবরাহ করে, তাহলে এয়ারবাস তাদের বিমানের জন্য যেসব আমেরিকান যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, তার সরবরাহ আমেরিকা বন্ধ করে দিতে পারে। এসব কিছুর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সম্ভবত তিনিই তাঁর যেকোনো পূর্বসূরির চেয়ে আমেরিকাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করতে পেরেছেন। ইরান চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সময়ই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এর বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি তিনি নজিরবিহীনভাবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি মার্কিন কংগ্রেসের কাছে এই চুক্তি না করতে আবেদন জানিয়েছিলেন।
ইরান চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ায় ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের এত দিন ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়ে ইরানি প্রশিক্ষক ও যোদ্ধাদের ব্যাপক ভূমিকা আছে। তবে ইরানের হাতে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী ব্যবস্থা না থাকায় ইসরায়েলের শক্তিশালী বিমানবাহিনীর সামনে সে অনেকটাই অসহায়। আমার মনে হয়, ইসরায়েলের আচরণের সঙ্গে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট থিয়োডর রুজভেল্টের একটি বাণীর মিল রয়েছে, ‘কথা মোলায়েমভাবে বলো, কিন্তু হাতে রাখো শক্ত লাঠি।’ অন্যদিকে ইরানের নেতারা করেছেন উল্টো আচরণ। ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ যখন ইসরায়েলকে ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছিলেন, তখন তিনি বুঝতে পারেননি এই হুমকিই তাঁদের জন্য উপহার হিসেবে কাজ করবে। ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার অজুহাত তিনিই তৈরি করে গিয়েছেন।
ইসরায়েল যে আমেরিকার দিক থেকে কী মাত্রায় সমর্থন ভোগ করে, তা বেশির ভাগ আরব দেশ আন্দাজ করতে পারে না। আমেরিকার প্রায় পাঁচ কোটি খ্রিষ্টান ইভানজেলিস্ট ট্রাম্প ও ইসরায়েলের অন্ধ সমর্থক। ইসরায়েলের সঙ্গে বেশির ভাগ পশ্চিমা সমাজের সামঞ্জস্য রয়েছে। আমেরিকার কৌশলপ্রণেতাদের একটি বড় অংশেই রয়েছে ইহুদিরা।
১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল সিরিয়ার গোলান উপত্যকা দখল করে নেওয়ার পর ওই অঞ্চলের কৌশলগত অবস্থান পাল্টে গেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে মিসর ও জর্ডান চুপ হয়ে গেছে। ইরাক ও সিরিয়া অনেক আগে থেকেই নিষ্ক্রিয়। এখন এই এলাকায় একমাত্র ইরানই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস রাখে। কিন্তু সে অবস্থা কি আর বেশি দিন ইরান ধরে রাখতে পারবে?