পাটকল চালাতে পারছে না সরকার

প্রথম আলো, ২২ জানুয়ারি ২০১৮
শুভংকর কর্মকার ও শেখ আল-এহসান, খুলনা থেকে ফিরে


সরকার পাটকল চালাতে পারছে না। বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো ভালো করছে, বেড়েছে তাদের রপ্তানি আয়। মুনাফাও করছে। কিন্তু পাটের এই সুসময়েও সরকারের হাতে থাকা ২২টি পাটকলের সবগুলোই লোকসানে চলছে। প্রতিবছর জনগণের করের টাকা দিয়ে সরকারি পাটকলগুলো টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।

সরকারি পাটকলে লোকসানের বড় কারণ কাঁচা পাট কেনায় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। তারা পাট কেনে দেরিতে ও বেশি দামে। এ ছাড়া সরকারি পাটকলের উৎপাদনশীলতা কম, উৎপাদন খরচ বেশি, যন্ত্রপাতি পুরোনো এবং বেসরকারি খাতের তুলনায় শ্রমিকের মজুরি বেশি।

লোকসান ও অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারি পাটকলগুলো প্রায়ই শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারে না। অবিক্রীত পণ্য গুদামে পড়ে থাকে। প্রতিবছরই পাটের মৌসুমে কাঁচা পাট কিনতে সরকারের কাছে হাত পাততে হয়। যেমন বকেয়া মজুরির দাবিতে খুলনা অঞ্চলের আটটি পাটকলের শ্রমিকেরা গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে উৎপাদন বন্ধ রেখে বিক্ষোভ করছেন। গত বৃহস্পতিবার দৌলতপুর ও খালিশপুর জুট মিল চালু হলেও এখনো ছয়টি পাটকল বন্ধ। দাবি আদায়ে গতকালও খুলনা শহরের বিভিন্ন এলাকায় লাঠি মিছিল করেছেন শ্রমিকেরা।

পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট। মিলস ফার্নিশিংস লিমিটেড নামের নন-জুট কারখানা ছাড়া বাকি ২৪ প্রতিষ্ঠান লোকসানে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএমসির পাটকলগুলোর (জুট ও নন-জুট) লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা।

সরকারি পাটকলের এই লোকসানের প্রবণতা অনেক পুরোনো। স্বাধীনতার পর দু-এক বছর ছাড়া প্রতিবছরই এসব পাটকল লোকসান দিয়েছে। সরকারের বোঝা কমাতে অতীতে বেশ কিছু পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পাট খাতকে লাভজনক করার অঙ্গীকার করে। তারা ক্ষমতায় আসার পর বিজেএমসিকে লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনা করে। এটি বাস্তবায়নে সরকার বিজেএমসির দেনা পরিশোধ করতে ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা দেয়। এই অর্থ দিলে ভবিষ্যতে বিজেএমসির জন্য আর কোনো আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হবে না—এ শর্তে পাট মন্ত্রণালয়, বিজেএমসি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। এরপর বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া খুলনার খালিশপুর জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী জুট মিলস ও ফোরাম কার্পেটস ফ্যাক্টরি ফিরিয়ে নিয়ে চালু করে সরকার।

কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। লোকসান হতেই থাকে। বেসরকারি খাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়া মিলগুলোও বড় লোকসান দিতে থাকে। চলতে থাকে সরকারের কাছে হাত পাতা। ২০১৫ সালে পাট মন্ত্রণালয় বিজেএমসির জন্য ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো পুনরায় চালু করে মারাত্মক ভুল করেছে।’ এ বছরও কাঁচা পাট কিনতে সরকারের কাছে ১ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে বিজেএমসি।

পাটকলের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার যে পাটকল চালাতে পারছে না, সেটা দেখাই যাচ্ছে। করদাতাদের টাকা দিয়ে পাটকলগুলোকে টিকিয়ে রাখা শ্রমিকস্বার্থের জন্য ভালো, সেটা আমার মনে হয় না।’ তিনি বলেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা, পাটকলগুলোকে লাভজনক করতে হলে শ্রমিকসংখ্যা, আকার ও প্রযুক্তি যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। পণ্য তৈরি করতে হবে চাহিদা অনুযায়ী। সব মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থাটিকে সংস্কার করতে হবে।

কেন লোকসান?

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর এই লেজেগোবরে অবস্থার কারণ খুঁজতে খুলনার খালিশপুরের কয়েকটি পাটকলের শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের অভিযোগ, ভরা মৌসুমে পাটের দাম কম থাকে। কিন্তু তখন বিজেএমসি কেনে না। দাম বাড়ার পর তারা মাঠে নামে। অন্যদিকে বিপণন বিভাগের অদক্ষতার কারণে পাটপণ্যের দাম কম মেলে। পণ্য অবিক্রীত থাকে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের কার্যকরী আহ্বায়ক সোহরাব হোসেন বলেন, বিজেএমসি ১ হাজার ২০০ টাকা মণের কাঁচা পাট কেনে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। সময়ের পাট অসময়ে কিনতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায়।

সরকারি পাটকলে উৎপাদনশীলতা কম। সরকারি পাটকলে এক টন চটের বস্তা তৈরিতে গড়ে ৯০ জন শ্রমিক লাগে। বেসরকারি মিলগুলো একই পরিমাণ পণ্য উৎপাদনে শ্রমিক ব্যবহার করে ২৫ থেকে ৩০ জন।

খুলনার বেসরকারি পাটকল জুট টেক্সটাইল মিলসের কর্মকর্তা এস এম শহীদুল আলম বলেন, বেসরকারি পাটকলে এক টন চটের বস্তা তৈরিতে শ্রমিক ৩০ জনের বেশি লাগলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

দুই পক্ষের অজুহাতই শ্রমিক!

সরকার বলছে, শ্রমিকের স্বার্থে লোকসান দিয়ে পাটকল চালাতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিজেএমসি লোকসানের জন্য শ্রমিকদের বেশি মজুরি ও সংখ্যা বেশি হওয়াকে দায়ী করে।

বিজেএমসির চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, স্থায়ী শ্রমিকদের উচ্চ মজুরি পাটকলগুলোর লোকসানের প্রধান কারণ। প্রয়োজনের চেয়ে শ্রমিক বেশি। এ জন্য উৎপাদন খরচ বাড়ে।

বিজেএমসি জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে গত জুনে ৩৩ হাজার ১৯১ স্থায়ী শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছিল। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি শ্রমিক ও দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক আরও ৩০ হাজার ৯৫২ জন। গত অর্থবছর সংস্থাটির আয় ছিল ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ বা ৬৫১ কোটি টাকা শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার মজুরি ও বেতন বাবদ ব্যয় হয়েছে।

শ্রমিকনেতা সোহরাব হোসেন বলেন, মজুরি বেশি হওয়া কখনো লোকসানের কারণ নয়। বিজেএমসির ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকলে পাটকল লোকসানে পড়ত না। জনবল বরং প্রয়োজনের তুলনায় কম আছে। অবসরে যাওয়া স্থায়ী শ্রমিকের শূন্য পদে নিয়োগ হচ্ছে না।

অথচ বেসরকারি খাতে সুসময়

এদিকে দেশের পাট খাতে ভালো সময় চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ। এর মধ্যে পাটকলগুলোর উৎপাদিত মূল পণ্য পাটসুতা ৩৩ শতাংশ এবং চট ও বস্তা রপ্তানি ৬ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানির ৮০ শতাংশই বেসরকারি পাটকলের দখলে।

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) মুখপাত্র শহীদুল করিম বলেন, বেসরকারি পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো, উৎপাদনশীলতা বেশি ও উৎপাদন খরচ কম। তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসা আবেগ দিয়ে হয় না। পাটকলের ব্যবসা নির্ভর করে কাঁচা পাট কেনার ওপর। কোনো পাটকল ১০০ টাকার পাট যদি ১৫০ টাকায় কেনে, তাহলে লাভ করবে কীভাবে?’

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এরপরই বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়া বিভিন্ন পাটকল সরকার নিজের হাতে নিয়ে এসে নতুন করে চালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সরকার চালাতে পারেনি। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো নিয়ে বিপাকেই আছে সরকার। আর মজুরির দাবিতে শ্রমিকেরাও আন্দোলনে আছেন।

Add a Comment