‘সব সমস্যা সমাধানের’ বিষয় নয়
|প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল ২০১৮
ড. সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক
২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) প্রথম পর্যালোচনায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য তিনটি মানদণ্ড সফলভাবে পূরণ করেছে। আশা করা যায় যে বাংলাদেশ ২০২১ সালে দ্বিতীয় পর্যালোচনায়ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের মাপকাঠি পূরণ করতে সক্ষম হবে। এতে করে বাংলাদেশের অবশেষে ২০২৪ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক লাভের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থার উচ্চতর রেটিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
অবশ্য এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। অর্থনৈতিক মডেলের সাহায্যে গবেষণালব্ধ হিসাব থেকে প্রতীয়মান হয় যে ২০২৭ সালে (যদি বাংলাদেশ ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যায় এবং তাতে করে ২০২৭ সালে বাংলাদেশের বাণিজ্য-সুবিধা শেষ হয়ে যায়) ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও চীনের বাজারে বাণিজ্য-সুবিধা হারানোর ফলে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১১ শতাংশ হারে বার্ষিক হ্রাস হতে পারে, যা রপ্তানি বৃদ্ধির বর্তমান প্রক্ষেপণের সাপেক্ষে ২০২৭ সালে প্রায় ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য হতে পারে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বর্তমানে ওষুধশিল্পে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব আইনের যে ধরনের বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে, তা ২০২৭ সাল নাগাদ বাতিল হয়ে যেতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বেশ কিছু চুক্তির (বিশেষ করে কৃষি ও শিল্প খাতে ভর্তুকি এবং শুল্কহার কমানো) আওতার বাইরে, যা ২০২৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশের জন্য পালনীয় হতে পারে। এ ছাড়া, যেহেতু বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘নিম্ন আয়ের’ দেশ থেকে ‘নিম্নমধ্যম আয়ের’ দেশে উত্তরণ লাভ করেছে, সেহেতু কম সুদে ঋণের সুযোগ সামনের দিনগুলোতে কমে আসবে।
এখানে উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে উল্লিখিত সম্ভাব্য সুবিধাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাওয়া যাবে না। এই সুফলগুলো বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশকে অনেক কাজ করতে হবে। এর বিপরীতে, যখনই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে, প্রায় সব সম্ভাব্য ক্ষতিই আপনাআপনিই ঘটবে, সে জন্য বাংলাদেশকে কিছুই করতে হবে না। অতএব, এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আগামী ৯ বছরে (২০২৭ সালের মধ্যে) বাংলাদেশের সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া খুব প্রয়োজন।
১৯৮০ ও ২০১৬ সালের মধ্যে আন্তদেশীয় প্রেক্ষাপটে মাথাপিছু জাতীয় আয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আমরা ১৪০টি দেশের অভিজ্ঞতা (উচ্চ আয়ের দেশ বাদে) তুলনা করেছি। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল মাত্র ২০৬ মার্কিন ডলার, যা ২০১৬ সালে ১ হাজার ৪৩৩ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এটা প্রতীয়মান যে কিছু দেশের, যেমন সোমালিয়া, কম্বোডিয়া, নেপাল, চাদ ও মিয়ানমারের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১৯৮০ ও ২০১৬ উভয় সালেই বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের তুলনায় কম ছিল। তবে যদিও ১৯৮০ সালে সাব-সাহারান আফ্রিকার অধিকাংশ দেশেরই মাথাপিছু জাতীয় আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল, ২০১৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ওই সব দেশকে ছাড়িয়ে যায়। এ থেকে বোঝা যায়, সাড়ে তিন দশক ধরে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বেশির ভাগ সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোকে পেছনে ফেলেছে। এই চিত্রের বিপরীতে ১৯৮০ সালে ভিয়েতনাম ও লাও-পিডিআরের মাথাপিছু জাতীয় আয় বাংলাদেশের তুলনায় বেশ কম হলেও ২০১৬ সালে এই দুটি দেশই বাংলাদেশের তুলনায় বেশ এগিয়ে গেছে। ১৯৮০ সালে ভিয়েতনাম ও লাও-পিডিআরের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল যথাক্রমে ৪৩ মার্কিন ডলার ও ১০২ মার্কিন ডলার, যা ২০১৬ সাল নাগাদ যথাক্রমে ২ হাজার ৫৯ মার্কিন ডলার ও ২ হাজার ২৩৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।
বেশ কিছু দেশ আছে যারা ১৯৮০ ও ২০১৬ উভয় সালেই মাথাপিছু জাতীয় আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের চেয়ে উচ্চতর অবস্থানে ছিল। তবে ২০১৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ এদের অনেকের সঙ্গে (বেশির ভাগই ধীরগতির প্রবৃদ্ধিসম্পন্ন মধ্যম আয়ের দেশ) ব্যবধান কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে অনেক দেশের সঙ্গেই (যেমন চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, বোতসোয়ানা ও পোল্যান্ডের মতো উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ) বাংলাদেশের ব্যবধানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উক্ত বিশ্লেষণটি থেকে দেখা যায়, যদিও সাড়ে তিন দশক ধরে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর তুলনায় অনেক ভালো করেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ও আফ্রিকার উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশের কৃতিত্ব অনেক কম।
এ কথা অনস্বীকার্য যে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য নগণ্য। এ ছাড়া রপ্তানির বহুমুখিতার অভাব, দুর্বল প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা, দুর্বল ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বড় অন্তরায়। বাংলাদেশের জানা এবং শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন যে কীভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ও আফ্রিকার উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ওই দেশগুলো বেশি পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে, কীভাবে তারা তাদের রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণ করতে সক্ষম হয়েছে, কীভাবে প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়াতে পেরেছে এবং কীভাবে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া এই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গুণগত মানের উন্নতি সাধন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মানসম্মত সেবা প্রদানের বড় ধরনের অগ্রগতি ছাড়া উন্নয়ন-প্রক্রিয়া বজায় রাখা খুবই কঠিন।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘটনা কোনোভাবেই ‘সব সমস্যা সমাধানের’ বিষয় নয়। এ কথা মোটামুটি আশা করা যায় যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। কিন্তু এই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ করার অবকাশ আছে যে বিদ্যমান ও গতানুগতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে আরও বড় ও গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে কি না।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের বিষয় এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের বিষয় এক নয়। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হবে, কীভাবে দেশটি মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে পারে। সর্বোপরি ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জের কাজ হবে। পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি কঠিন হবে বলে মনে হয়। এই সবকিছুই নির্দেশ করে যে আগামী দিনগুলোতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অসাধারণ কিছু হতে হবে।