রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্য পথ***
|প্রথম আলো, ০২ এপ্রিল ২০১৮
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান : সাবেক সচিব ও অধ্যাপক
গত ২৫-২৭ মার্চ আমরা কুতুপালং-২ ও বালুখালী-১ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করি। এটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগ। আমার ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সাকিব মাহমুদ রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য আমার সাহায্য চায়। তার উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত হয় দেশ-বিদেশে আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, ছাত্র ও সহকর্মীর সহায়তা। আমরা শরণার্থীদের মধ্যে সেলাই মেশিন, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল, ঢাকনাযুক্ত বালতি, লুঙ্গি, থামি, মশারি, ছাতা ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করি। ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে দেখি, কেউ কেউ আনত চোখে ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করছেন, অর্থাৎ লজ্জা বোধ করছেন। এ থেকে অনুমান করি, তাঁরা শিগগিরই তাঁদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান।
এর আগেও গত বছর অক্টোবর মাসে একই এলাকায় আমরা সাহায্য কার্যক্রম চালাই। দেখলাম, গতবারের তুলনায় এবার ব্যক্তি উদ্যোগ অনেকটা সীমিত হয়ে এসেছে। এটা স্বাভাবিক। আমরা সেনাবাহিনী পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের সহায়তায় সাহায্য-সামগ্রী বিতরণ করি। মানতেই হবে, সেনাবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করছে। কিন্তু কত দিন সেনাবাহিনী এ দায়িত্ব পালন করবে? বাংলাদেশই বা আর কত দিন এসব শরণার্থীর দেখভাল করবে?
শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের গড় সময়সীমা-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান আশাব্যঞ্জক নয়। ইউএনএইচসিআর কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের গড় সময়সীমা ১৭ বছর। এ পরিসংখ্যানটি সঠিক নয় বলে এর বিকল্প যে হিসাব প্রদান করা হয়েছে, তাতেও গড় সময়সীমা ১০ বছরের মতো। অর্থাৎ, প্রচলিত ধারা অনুসরণ করলে দীর্ঘদিন বাংলাদেশকে এ দায় বয়ে বেড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিন এ সমস্যা অব্যাহত থাকলে ব্যক্তি উদ্যোগের মতো আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক ত্রাণের ধারাটিও ক্ষীণ হয়ে আসবে।
তাই দ্রুত কীভাবে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো যায়, সে বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমি এখানে তিনটি বিকল্প ও একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি দেখতে পাচ্ছি।
মিয়ানমারের সুমতি
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফে অবস্থিত স্থলবন্দরে গিয়ে দেখলাম, রোহিঙ্গা সমস্যা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি অব্যাহত আছে এবং মিয়ানমার থেকে আমদানি প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির তুলনায় মিয়ানমার থেকে আমদানির পরিমাণ ১০ গুণেরও বেশি। স্থলবাণিজ্য ছাড়াও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলে পর্যটন, জ্বালানি অনুসন্ধান ও বাণিজ্য ইত্যাদি নানা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশ উপকৃত হতে পারে। সু চির সরকার, বিশেষ করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা, এটা অনুধাবন করে দুই পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-সংক্রান্ত চুক্তি আশু ও দ্রুত বাস্তবায়ন করে নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থাভাজন হতে পারে। এতে করে সু চিও তাঁর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারবেন।
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকেই মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গারা ছাড়াও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে কাচিন বিদ্রোহী, কারেন্নি আর্মি, কারেন ও শান স্টেট আর্মি। অর্থাৎ, বার্মা দেশ হিসেবে স্বাধীন হলেও তারা একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন।
অং সান সু চিকে ঘিরে মিয়ানমারে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা আপসের চোরাবালিতে আটকে গেছে। জনগণকে মুক্ত করার আন্দোলনে লিপ্ত সু চি নিজেই সামরিক জান্তার কাছে বন্দী হয়ে তাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক গণহত্যায় মদদ দিয়েছেন কিংবা নির্লিপ্ত থেকেছেন। মিয়ানমারে নিশ্চয়ই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও গণতান্ত্রিক বোধে উদ্বুদ্ধ মানুষ আছেন।
আশা করা যায়, তাঁরা একদিন জেগে উঠবেন, নিজেদের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন। এ ধরনের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলেই রোহিঙ্গারা নির্ভয়ে ও নিরাপত্তায় স্বদেশে ফিরতে পারবে।
আন্তর্জাতিক চাপ
চারভাবে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা যেতে পারে, তবে এগুলোর প্রতিটিরই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমটি হলো বাণিজ্য ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা। মিয়ানমার দীর্ঘদিন এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার পর তা থেকে ক্রমে বের হয়ে এসেছে। তারা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাই নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও তা কতটা সফল হবে, তা বলা মুশকিল। তা ছাড়া, নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য যে আন্তর্জাতিক জনসমর্থন প্রয়োজন, তা এ মুহূর্তে নেই বলেই মনে হয়। জাতিসংঘ ছাড়াও আঞ্চলিক সংগঠন আসিয়ান এবং ওআইসির মতো সংগঠনগুলোও এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয় চাপ প্রদানের উপায় হলো, মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন। রাশিয়া ও চীনের সমর্থনের অভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ থেকে এ ধরনের অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তৃতীয় উপায় হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও সু চিকে জাতিগত নির্মূল অভিযান ও গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করা। উল্লেখ্য, মিয়ানমার এ ধরনের বিচার-সংক্রান্ত চুক্তির স্বাক্ষরদাতা দেশ নয় বিধায় আদালতের সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। চতুর্থ উপায় হলো, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো, বিশেষ করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক মিয়ানমারে তাদের সহায়তা স্থগিত রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের সম্মতির প্রয়োজন হবে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সব দ্বিপক্ষীয় ও বহুজাতিক বিকল্পগুলোর মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হতে হবে। সর্বোপরি চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তাদের সহযোগিতা ও সমর্থন আদায় করতে হবে।
অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি
দীর্ঘদিন অসহনীয় ও মানবেতর পরিবেশে থেকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে চরমপন্থার উত্থান হতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত নীতি হলো, কোনো প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহৃত হতে না দেওয়া এবং বাংলাদেশ এই নীতিতে সর্বদা অবিচল আছে। রোহিঙ্গারা যাতে এ ধরনের কোনো কার্যকলাপে লিপ্ত হতে না পারে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ সর্বক্ষণ নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন এ মানবিক বিপর্যয় অব্যাহত থাকলে, রোহিঙ্গারা বিপথগামী হতে পারে এবং তাদের উৎসাহ প্রদানের জন্য বিভিন্ন অশুভ শক্তি ওত পেতে আছে। নিজের দেশের পাশে এ ধরনের পরিস্থিতি কখনোই বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারত কারোরই কাম্য হতে পারে না। আবার দীর্ঘদিন এ অচলাবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যা কারও কাম্য নয়।