আগে শুধুই উন্নয়ন, গণতন্ত্র বা পরিবেশ পরে***
|প্রথম আলো, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
নির্বাচনের সময় কোনো না কোনো ইস্যুকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের সামনে হাজির হতে হয়। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইস্যু সম্ভবত ‘উন্নয়ন’। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মুখে এমনটাই আমরা শুনতে পাচ্ছি। সরকার তার মেয়াদের শেষ বছরে এসে পৌঁছেছে, চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় সরকারের আয়োজন ছিল ‘উন্নয়ন মেলা’। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় চেতনা ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে দলটির নেতাদের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ‘উন্নয়নে’র বাইরে আর কিছুই নেই।
দেশে নানা বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে এবং সেগুলোই সরকার ‘উন্নয়ন’ হিসেবে তুলে ধরছে। আর এসব উন্নয়নই গণতন্ত্রকে এখন পেছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গণতন্ত্রকে ভিলেন বানিয়ে একে দাঁড় করানো হচ্ছে উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবে। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন যে হাত ধরাধরি করে চলে ও চলতে পারে, বিশ্বের সেসব উদাহরণ বিবেচনায় না নিয়ে আমরা ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছি। আমরা মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশকে মডেল হিসেবে ধরে নিচ্ছি। আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল ও অর্থনীতিবিদেরও কারও কারও এমন অবস্থানের প্রতি সায় রয়েছে বলে মনে হয়। সরাসরি না বললেও ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে অনেকে যা বলতে চান তা হচ্ছে, আগে উন্নয়ন হোক, গণতন্ত্রের বিষয়টি পরে দেখা যাবে। কিন্তু সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা কী বলে? উন্নয়ন সেখানে হয়েছে বা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু উন্নয়নের পর গণতন্ত্রে ফিরে আসার কোনো লক্ষণ কি আদৌ আছে? যে গণতন্ত্র আমাদের চাওয়া বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে গণতন্ত্রের কথা বলে সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় তা নেই।
এখন যদি আমরা এটা মেনে নিই যে গণতন্ত্র ছাড়া শুধু উন্নয়নেই আমাদের চলবে, তাহলে সেই উন্নয়নটা কেমন হচ্ছে বা এর সুফল জনগণ কোন মাত্রায় পাচ্ছে বা পাবে, সেই হিসাব-নিকাশটি করা আমাদের জন্য জরুরি। বর্তমান সরকারের ‘উন্নয়নের’ কিছু মাইলফলকের কথা আমাদের জানা আছে। সড়কের লেন বাড়ছে, সেতু ও উড়ালসড়ক হচ্ছে, বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। সমুদ্র ও এলএনজি আমদানির বন্দর বা নতুন নতুন অর্থনৈতিক ক্ষেত্র-নানা কিছুই হচ্ছে। তবে এখানে মনে রাখা ভালো, বাংলাদেশে উড়ালসড়ক, সেতু বা রাস্তা তৈরির খরচ কিলোমিটারের হিসাবে আশপাশের দেশ তো বটেই, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের তুলনায়ও বেশি। বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে চার লেনের সড়ক বানাতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ২৫ লাখ ডলার থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার। ভারতে এই খরচ ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ ডলার। এই হিসাব বিবেচনায় নিলে ঢাকা-মাওয়া সড়ক চার লেন করতে প্রতি কিলোমিটারের যে খরচ হচ্ছে, তা ভারতে তুলনায় প্রায় ১০ গুণ।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সড়ক বানাতে বেশি খরচের পেছনে কতগুলো কারণের কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে
বাজার থেকে সড়কের দূরত্ব,
দরপত্রে প্রতিযোগিতা না হওয়া,
প্রকল্প শেষ করতে দেরি হওয়া,
সংঘাত ও উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি।
তবে বাংলাদেশে এত খরচের পেছনে উচ্চমাত্রার দুর্নীতির বিষয়টিকে দায়ী করা হয়েছে। সহজ কথায় বললে, কমিশন বা ভাগ-বাঁটোয়ারা-এসবই এত খরচের জন্য দায়ী। বোঝা যাচ্ছে, যে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে, তার জন্য আমাদের চড়া দাম দিতে হচ্ছে। একদিকে গণতন্ত্রকে ছাড় দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে উন্নয়নের নামে জনগণের পয়সার ভাগ-বাঁটোয়ারাকে মেনে নিতে হচ্ছে।
আসলে উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তাঘাট, সেতু বা উড়ালসড়ক অথবা অবকাঠামো তৈরিকে ধরে নেওয়ার যে বিপদ, আমরা এখন সেই পাকে পড়েছি। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কাছে একটি দেশের ‘উন্নয়নের’ পরিসরটি অনেক বড়। তিনি উন্নয়ন বলতে অবকাঠামোর উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্রের উন্নয়ন, মানবাধিকারের উন্নয়ন, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতার উন্নয়ন-এসবকেও বিবেচনায় নেন। এগুলো আমরা না হয় বাদই দিলাম। শুধু অবকাঠামো উন্নয়নকেই যদি আমরা ‘উন্নয়ন’ হিসেবে ধরে নিই, তবে সেই উন্নয়নের ফল পেতে হলে যে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, প্রতিষ্ঠানের দক্ষতার উন্নয়ন-এসবের সম্পর্ক রয়েছে, তা কি আমরা মাথায় রেখেছি?
ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে বেশ কিছু উড়ালসড়ক হয়েছে। শহর দুটির কিছু রাস্তা ঢেকে গেছে ‘উন্নয়ন অবকাঠামোয়’। প্রবলভাবে দৃশ্যমান এসব ‘উন্নয়নের’ পরও ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি আর হাঁটার গতির মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, ঢাকায় যানবাহনের গতি এখন গড়ে সাত কিলোমিটার। আর মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। চট্টগ্রামে বানানো উড়ালসড়কগুলো যেন শহরটির জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যে উড়ালসড়কগুলো বানানো হলো, মনে হচ্ছে এগুলো বানানোই ছিল আসল কাজ। এগুলো আদৌ কাজে আসবে কি না বা এগুলো তৈরি করার পর এর ব্যবস্থাপনা বলেও যে একটি বিষয় রয়েছে, তা আদৌ বিবেচনায় ছিল বা আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার উড়ালসড়কগুলোর নিচে কী হচ্ছে? কোথাও বাজার বসেছে, সেখানে মাছ ও মুরগি কেটে বিক্রি হচ্ছে। কোথাও ঘোড়ার আস্তাবল হয়েছে, বাস-ট্রাকসহ যানবাহনের ‘টার্মিনাল’ হয়েছে, গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে, ছিন্নমূল মানুষেরা কোথাও বসত গড়েছে, হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়। সরকার সম্ভবত মনে করছে যে উড়ালসড়ক বা এর কাঠামোটি বানিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ! এসব কি তবে শুধুই ‘উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন’? উন্নয়নের সঙ্গে যে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক রয়েছে, তা কি আমরা মেনে চলছি? এত দামি ‘উন্নয়ন’ আমাদের আসলে কী দিচ্ছে?
যারা সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রে ছাড়কে মেনে নেওয়ার পক্ষে, তাদের বলি, ওই দেশ দুটিতে কি উন্নয়ন অবকাঠামো বানাতে লাগামছাড়া অর্থ খরচ করা যায়? আমাদের মৌচাক-মগবাজার উড়ালসড়কে সিগন্যাল বসাতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকশায় ত্রুটির কারণে এমন হয়েছে। এর জন্য কি কাউকে জবাবদিহি করতে হয়েছে? এই উড়ালসড়কটি বাংলামোটরে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, তা কি পরিকল্পনাকারীরা আদৌ বিবেচনায় নিয়েছিলেন? অথবা এই উড়ালসড়কের কারণে যে দরকারি গণপরিবহনব্যবস্থা বাস র্যাপিড ট্রানজিটে (বিআরটি) একটি রুট ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তার কোনো জবাব কি পাওয়া গেছে? সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় কি এমন পরিকল্পনাহীন কাজ সম্ভব? অথবা জবাবদিহির বাইরে থাকা যায়? দুর্নীতি, অযোগ্যতা-এসবের জন্য তো ওই দেশগুলোয় জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হয়। আমাদের দেশে কি এমন কোনো নজির আছে?
পদ্মা সেতু বানানোর ব্যয় শুরুতে যা ধরা হয়েছিল, এখন তা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। এখন কাজ শুরু করার পর নদীর নিচে নরম মাটির কথা শোনা যাচ্ছে। এতে কাজ শেষ করতে দেরি হওয়া ও খরচ বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। খরচের মাত্রা যেখানে গিয়ে ঠেকতে যাচ্ছে, তাতে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ ও প্রকল্প থেকে পাওয়া সুবিধার অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ মিলবে তো? আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র লাগবে এবং বিদ্যুৎ বানাতে শুধু গ্যাসের ওপর নির্ভর করা থেকে আমাদের নিশ্চয়ই সরে আসতে হবে। কিন্তু সেই সরে আসাটা বাস্তবসম্মতভাবে হচ্ছে তো? রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির ক্ষেত্রেও সেই বাড়তি খরচের অভিযোগ। ভারত, তুরস্ক ও বেলারুশে এ ধরনের যে প্রকল্পগুলোর কাজ হচ্ছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে খরচ অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের সূত্রে আমরা জানতে পারছি। এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম সহনীয় মাত্রায় থাকবে তো? এসব প্রকল্পকে সরকার তাদের কীর্তি বা সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করতে পারে, যত খরচ করেই হোক, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে হয়তো তা এই সরকারের সৃষ্টি এক অনন্য স্থাপনা হিসেবে থেকে যাবে। কিন্তু কোনো উন্নয়ন প্রকল্পকে কি এভাবে দেখা যায়? এর অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও জনকল্যাণের বিষয়টিই তো সব হওয়ার কথা।
গণতন্ত্রকে ছাড় দিয়ে ও মাত্রাছাড়া খরচ করে আমরা যে উন্নয়ন পাচ্ছি, তার আরও এক বড় শিকার হচ্ছে পরিবেশ। ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’-এই বাস্তবতাকে তো আমরা অনেকটা মেনেই নিয়েছি, এখন সম্ভবত আমাদের ‘আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ’-এই বাস্তবতাকেও মেনে নিতে হবে। রামপালকে ঠেকানো যায়নি, যাচ্ছে না। ‘উন্নয়নের’ জন্য বনের জমিই এখন ভরসা। বন বিভাগ শুধু সরকারকে নয়, উন্নয়নের জন্য বেসরকারি খাতকেও জমি বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। দুই খাতে এ পর্যন্ত বন বিভাগের দেওয়া জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার একর। আরও ১৬ হাজার একর বনভূমির জমি বরাদ্দের জন্য আবেদন করা আছে। সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় কি এমন কাজ সম্ভব?
আমাদের সম্ভবত কিছুই বিবেচনার দরকার নেই। শুধু ‘উন্নয়ন’ হলেই চলবে।