কৃষ্ণকান্তের উইল

‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের রোহিনী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করুন। (৩৭তম বিসিএস লিখিত)

কৃষ্ণকান্তের উইল বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি বাংলা সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৮৭৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। রোহিনী, ভ্রমর এবং গোবিন্দলালের ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী বর্নিত হয়েছে কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে। ১৮৮২ ও ১৮৮৪ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংস্করণ ১৮৯২ সালে মুদ্রিত।

কৃষ্ণকান্তের উইল এর রোহিনী
কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের অন্যতম আলোচিত চরিত্র এবং বাংলা সাহিত্যের এক অমর চরিত্র হচ্ছে রোহিনী। উপন্যাসের শুরুতেই রোহিনীকে আমরা পাই একজন বাল্য বিধবা রূপে। অসাধারণ সুন্দরী, সর্ব কাজে পটু, তার কিছু দোষও তুলে ধরা হয় উপন্যাসে এভাবে যে,

দোষ সে কালা পেড়ে ধুতি পরিত, হাতে চুড়ি পরিত, পানও বুঝি খাইত।

প্রথমেই সে কৃষ্ণকান্তের সঙ্গে প্রতারণা করে হরলাল কে বিয়ে করার জন্য। যদিও এখানে রোহিনীর সাথে হরলালকেও দোষী করা যায়। হরলাল ও রোহিনীর সাথে প্রতারণা করে। তাই বলে যে,

আমি যাই হই–কৃষ্ণকান্ত রায়ের পুত্র, সে চুরি করিয়াছে তাহাকে কখনো গৃহিনী করিতে পারিব না।

তারপরই সে প্রেমে পড়ল কৃষ্ণকান্ত রায়ের ভাতুষ্পু্ত্র গোবিন্দলালের। বঙ্কিমের ভাষায়,

তুমি বসন্তের কোকিল। প্রাণ ভরিয়া ডাক, তাহাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তোমার প্রতি আনুরোধ সময় বুঝিয়া ডাকিবে।

এখানে এসে আসলেই রোহিনীর মত মেয়ের উপর দয়া হয়। প্রেমে পড়লে সোনা খাঁটি হয়– এমতেই রোহিনী গোবিন্দলালের জন্য নিজের করা দোষ স্বীকার করে। গোবিন্দলালও তার প্রতি করুণাবশত তাকে মুক্ত করতে চায় কৃষ্ণকান্তের শাস্তি থেকে। তখনই রোহিনী গোবিন্দকে নিজের ভাল লাগার কথা বলে ফেলে। লেখক এখানে গোবিন্দলাল এবং রোহিনীর প্রেমকে অনেকটা পবিত্র রূপে উপস্থাপন করে। যার কারণে দেখা যায় , রোহিনী গোবিন্দকে পাবে না জেনে আত্নহত্যা করতে যায়। আর তাতেই গোবিন্দলাল রোহিনীর প্রেমে পড়ে যায়।

রোহিনীর কূটিলতার অন্যতম উদাহরণ যখন সে ভ্রমরের (গোবিন্দলালের স্ত্রী) ভুল ভাঙাতে না গিয়ে বরং তার বেদনা আরো বাড়িয়ে দিতে যায়। তার ভাষায়,

লোকে যতটা বলে ততটা নহে। লোকে বলে, আমি সাত হাজার টাকার গহনা পাইয়াছি। মোটে তিন হাজার টাকার গ হনা আর এই শাড়ি খানা (ধার করা) পাইয়াছি।

এভাবেই সে ভ্রমরের মনোবেদনা শতগুণ বাড়িয়ে দিয়ে গেল।

রোহিনীর কূটিলতার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় যখন সে তারেকেশ্বরে হত্যা দিতে যাবার নাম করে যশোর গিয়ে গোবিন্দ লালের সাথে থাকতে শুরু করে। রোহিনীর কূটিলতা এবং অদম্য সাহসের জন্য বারে বারে সে ভুল গুলো করছিল। এমনই ভুল আবার করল যখন সে নিশাকরকে পছন্দ করতে শুরু করল।তার ভাষায়,

— আ মরি! কি চোখ! এ কোথা থেকে এল? হলুদ গাঁয়ের লোকত নয়- সেখানকার সবাইকে চিনি। ওর সাথে দুইটি কথা কইতে পাই না? ক্ষতি কি-

এভাবেই সে নিজেকে আবার ভুলের পথে নিয়ে গেল। সে বিশ্বাসঘাতিনী না হলেও মনের সততা সম্ভ্রম চলে গিয়েছিল। হাতে নাতে গোবিন্দলালের কাছে যখন সে ধরা পরে গিয়েছিল তখন গোবিন্দলালা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে,

কেমন মরিতে পারিবে?

রোহিনী পারিল না। কেন না যখন সে বরূণীর জলে ডুবে মরতে গিয়েছিল তখন সে গোবিন্দলালকে ভালবেসেছিল এবং না পাওয়ার আশঙ্কায় মরতে গিয়েছিল। এখন পারেনি কারণ সে গোবিন্দলালকে পেয়েছে এবং সেই সাথে অন্য একজনকেও মনে ধরেছে। রোহিনীরা সাধারণত এ ধরণেরই হয়ে থাকে।

বঙ্কিম এ চরিত্রটিকে খল বা কূটিল চরিত্র হিসেবে রূপায়িত করেছেন এক ধরণের সহানুভূতি নিয়ে। সে কূটিল কিন্তু সেই কূটিলতার পেছনের কারন গুলো ও দেখিয়েছেন অত্যন্ত সূচারূভাবে আর সুন্দরভাবে। যার কারণে রোহিনীকে ঘৃনা করতে চাইলেও ঘৃনা করা যায় না। এখানেই বঙ্কিমের কৃতিত্ব।

ভ্রমর:
এই উপন্যাসের অন্যান্য নারী চরিত্রের মধ্যে আরেকটি নারী চরিত্র ভ্রমর। উপম্যাস ব্যাপী তার বিস্তার। তার কারণেই রোহিনীকে সংজ্ঞায়িত করা গেছে কূটিল হিসেবে। বঙ্কিম সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন চরিত্রকে অঙ্কিত করেন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে। কিন্তু দুটি চরিত্রের দুর্লতম দিক গোবিন্দলালের কাছে এসে একাকার হয়ে গেছে।

উপন্যাসের এই চরিত্রটি গোবিন্দলালের স্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত সহজ সরল গৃহবধূ যার কাছে স্বামীই সব। তার মতে স্বামীকে অবিশ্বাস করতে নেই, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই স্বামীকে অনুসরণ করা স্ত্রীলোকের ধর্ম।

তার সরলতার একটা উদাহরণ, যখন রোহিনীকে চুরির দায়ে বন্দী করল কৃষ্ণকান্ত, তা শুনে গোবিন্দলাল বলল যে, সে বিশ্বাস করে না রোহিনী চুরি করতে পারে। তখন ভোমরা ও বলল সেও বিশ্বাস করে না। তখন গোবিন্দলাল জিজ্ঞেস করল, কেন? তখন ভোমরা উত্তর করল না। কারণ তার বিশ্বাস গোবিন্দলালের বিশ্বাস বলে।

ভ্রমর কোনদিন বিশ্বাস করে নি যে গোবিন্দলাল রোহিনীকে ভালবাসতে পারে। এটা টার চিন্তারই বাইরে। ভ্রমর গোবিন্দলালকে বিশ্বাস করত বলেই যখন গোবিন্দলাল বন্দরখালী গেল চাকরাণী সহ প্রত্যেকের এক এক কথা শুনে সত্যি জেনেও বিশ্বাস করতে চায়নি। বরং যারা বলেছে তাদের উপর ক্ষেপে যেত। ভ্রমর কাঁদতে কাঁদতে ভাবত ,

হে সন্দেহ ভঞ্জন !! হে প্রাণাধিক!! তুমে আমার সন্দেহ তুমি আমার বিশ্বাস !! আজ কাহাকে জিজ্ঞেসা করিব? আমার কি সন্দেহ হয়?

এভাবেই সে নিজেকেই প্রবোধ দিয়েছে। এখানেই বঙ্কিমের বড় কৃতিত্ব। নারী মনের কথা তিনি অতি সহজেই ব্যাখ্যা করেছেন।

গোবিন্দ যখন ভ্রমরকে কোন দোষ ছাড়া ত্যাগ করে যাচ্ছিল তখনো সে কিছু বলতে পারেনি। কারন সে এত আঘাত পেয়েছিল সে সে মূর্ছিতই হয়ে পড়ল। এইখানেই রোহিনীর সাথে তার বৈপরিত্য। রোহিনী হলে এখানে সে অনেক ধরণের কৌশল খাটাত। গোবিন্দলালকে শেষ পর্যন্ত ভ্রমরের কাছে ফিরতে হল। এভারে বঙ্কিম ভ্রমরকে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেন বলছেন সত্যেরই জয় হয় শেষ পর্যন্ত। ভ্রমর সরলতার গুণে যেমন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তেমনই রোহিনীও কূটিলতা বা কৌশলতার গুণে প্রধানা হয়ে উঠলেন। তবে তাঁদের কোন চরিত্রকেই ফেলা যায় না। ভ্রমরের সরলতার পরিণতি দেখে যেমন দু্ঃখ হয় তেমনই রোহিনীর কূটিল রূপ দেখে ঘৃণা হয়না।

সেকালের সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে দু’টি চরিত্রই স্বয়ংসম|পূর্ণ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। বঙ্কিম বলেছেন এভাবে,

যখন প্রসাদপুরে গোবিন্দলাল রোহিনীর সংগীত স্রোতে ভাসমান, তখই ভ্রমর তাহার চিত্তে প্রবল প্রতাপযুক্তঅধিশ্বরী-ভ্রমর অন্তরে রোহিনী বাইরে। তখন ভ্রমর অপ্রাপণীয়, রোহিনী অত্যাজ্যা, – তবুও ভ্রমর অন্তরে, রোহিনী বাইরে। তাই রোহিনী অত শীঘ্রই মরিল।

এখানে যদি জেন্ডার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করি , ব্যাখ্যা করাটাই বৃথা হবে। কেননা জেন্ডারের দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্রমরকে বলবে যেহেতু গোবিন্দলাল তোমার সাথে প্রতারণা করেছে সেহেতু তার জন্য তোমার সম্পূর্ণ জীবনটা উৎসর্গ করা ঠিক হয়নি। কিন্তু সে সময়ের প্রেক্ষাপটে নারী চরিত্রগুলোর পারিপার্শ্বিক অবস্থান অনুযায়ী বঙ্কিম তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তুলে ছিলেন। তখনকার সমাজে নারীদের গণ্ডি বড়ই ছোট ছিল। তখন পতির সাথে সহ মরণে যেতে হত। সেই যেই হোক সকল হিন্দু নারীরই এই বিধান ছিল। যদিও রাম মোহন রায় সতীদাহ প্রথা রোধ করেছিলেন। সুতরাং জেন্ডার বিশ্লেষণের মূল ভিত্তি সময়, অবস্থান , সমাজের গতি প্রকৃতি অনুসারে এটাই ছিল তখনকার জেন্ডার বাস্তবতা।

সংগ্রহঃ সামহয়ারইন ব্লগ – নুসরাত জাহান ডায়না

আরও দেখুন- বঙ্কিমের রোহিণী ও রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনী

Add a Comment