শূন্যপুরাণ

বৌদ্ধধর্ম যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন হিন্দু ধর্মের সাথে এর মিলন সাধনের উদ্দেশ্যে বৌদ্ধদের শূন্যবাদ ও হিন্দুদের লৌকিক ধর্মের সংমিশ্রণে ধর্মপূজার প্রতিষ্ঠা করেন রামাই পণ্ডিত। গদ্যপদ্য মিশ্রিত চম্পুকাব্য শূন্যপুরাণ ধর্মপূজার শাস্ত্রগ্রন্থ। এতে উল্লিখিত ধর্মপূজার বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। শূন্যপুরাণে সন্নিবেশিত ‘নিরঞ্জনের রুস্মা’ নামক কবিতাটি থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে যে এটি ‘মুসলমান তুর্কি কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের পরের’ অন্তত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকের রচনা।’

এতে বর্ণনা করা হয়েছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সধর্মীদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের কাহিনী। পাশাপাশি মুসলমানদের জাজপুর প্রবেশ এবং রাতারাতি ব্রাহ্মণ্যদেবদেবীর ধর্মান্তর গ্রহণের কাল্পনিক চিত্র জুড়ে দেয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা থেকে অনুমিত হয় গ্রন্থটি বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম সম্প্রসারণের প্রথম দিকের রচনা। গ্রন্থটিতে একদিকে ব্রাহ্মণ্য শাসনের সমাপ্তি অপরদিকে মুসলমানদের শাসন শুরুর পক্ষে মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে। নিম্নে এর ভাষার নমুনা উদ্ধৃত করা হলোঃ

আপনি চণ্ডিকা দেবী তিহঁ হৈলা হায়া বিবি’
পদ্মাবতী হৈলা বিবি নূর ।
জথেক দেবতাগণ সভে হয়্যা একমন
প্রবেশ করিল জাজপুর ॥
দেউল দেহারা ভাঙ্গে কাড়্যা ফিড়্যা খাএ রঙ্গে
পাখড় পাখড় বোলে বোল।
ধরিয়া ধর্মের পাএ রামাঞি পঞ্জিত গাএ
ই বড় বিষম গণ্ডগোল॥

উল্লিখিত রামাই পণ্ডিতের জীবনকালও ত্রয়োদশ শতক বলে অনুমান করা হয়। উদ্ধৃত ভাষার নমুনা এবং ব্রাহ্মণ্য শাসনাবসান ও মুসলমান শাসন প্রচলনের পক্ষে মত প্রকাশের মধ্য দিয়ে মূলত তৎকালীন সামাজিক অবস্থার পরিচয়ই মেলে ধরা হয়েছে।

মূল গ্রন্থে ধর্মপূজার যে বিবরণ আছে তাতে বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদ ও হিন্দু লোকধর্মের মিশ্রণ ঘটেছে। বঙ্গে পালদের পতন ও সেনদের আবির্ভাবে বৌদ্ধমত ও ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের যুগসন্ধিক্ষণের ধর্মীয় চেতনা থেকে ধর্মপূজার উদ্ভব হয়। রামাই পন্ডিত একে সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।

শূন্যপুরাণ গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে রচিত একটি চম্পূকাব্য। এর প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে বর্ণনা আছে। এতে ধর্মদেবতা নিরঞ্জনের যে কল্পনা করা হয়েছে তা বৌদ্ধদের শূন্যবাদের অনুরূপ। সেতাই, নীলাই, কংসাই, রামাই ও গোসাঁই এই পঞ্চপন্ডিত পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের প্রচ্ছন্ন রূপ। গ্রন্থের পরের ৪৬টি অধ্যায়ে ধর্মপূজার রীতি-পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। ‘দেবীর মনঞি’ অধ্যায়ে হিন্দুদের অনুরূপ পশুবলির কথা আছে; কিন্তু বৌদ্ধধর্মে পশুবলি নিষিদ্ধ। শেষের দুটি অধ্যায়ে নাথদেবতার উল্লেখ আছে। এটিও প্রক্ষিপ্ত, কেননা নাথধর্ম ও ধর্মপূজা দুটি ভিন্ন ধর্ম। ধর্মপূজা পশ্চিমবঙ্গে এবং নাথধর্ম উত্তরবঙ্গে প্রচারিত হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শূন্যপুরাণ শিল্পকর্ম হিসেবে নয়, ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই ঐতিহাসিক গুরুত্ব পেয়ে আসছে।

রামাই পণ্ডিত রচিত ধর্মপূজার শাস্ত্রগ্রন্থ শূন্যপুরাণ। এটি ৫১টি অধ্যায়ে বিভক্ত। রামাই পণ্ডিতের কাল ত্রয়োদশ শতক বলে অনেকেই অনুমান করেন। শূন্যপুরাণ ধর্মীয় তত্ত্বের গ্রন্থ যা গদ্যপদ্য মিশ্রিত চম্পু কাব্য। হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মিলন সাধনের জন্য রামাই পণ্ডিত ধর্মপূজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে বৌদ্ধদের শূন্যবাদ এবং হিন্দুদের লৌকিক ধর্মের মিশ্রণ ঘটেছে।

Add a Comment