রোসাং রাজসভায় বাংলা সাহিত্য
|আরাকান রাজসভায় যে সকল কবি বিশেষ পৃষ্ঠপোশকতা অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- দৌলত কাজী, মরদন কোরেশী, মাগন ঠাকুর, মহাকবি আলাওল, আবদুল করীম প্রমুখ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আরাকান রাজসভার নাম সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে বর্তমান মিয়ানমার তথা বার্মার অন্তর্ভুক্ত আরাকান রাজ্যে বাংলা কাব্য তথা সাহিত্য চর্চার বিষয়টি ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ‘রোসাঙ্গ’ বা ‘রোসাং’ নামে উল্লেখ করা হয়। বার্মার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ও বাংলাদেশের চট্টগ্রামের দক্ষিণে এর অবস্থান।
সে সময় আরাকান রাজ্যে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। (শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে এই প্রবাসী বাঙালী সমাজের একপ্রকার দৃশ্যমান পরিচয় পাওয়া সম্ভবপর হয়।)
আবার সমসাময়িককালে বঙ্গ-ভূভাগে মুঘল-পাঠান সংঘর্ষের ফলে অনেক অভিজাত মুসলমান আরাকান রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন সুফী মতালম্বী। তখন থেকেই আরাকান রাজসভায় আরবী-ফারসীতে বিদগ্ধ কবিকুলের বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। আরাকান রাজসভায় যে সকল কবি বিশেষ পৃষ্ঠপোশকতা অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- দৌলত কাজী, মরদন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মহাকবি আলাওল, আবদুল করীম খোন্দকার প্রমুখ। এঁরা আরবী-ফারসী কিংবা হিন্দী থেকে উপকরণ গ্রহণ করলেও মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করে স্বকীয় প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন।
সতেরো শতকে রাজা শ্রীসুধর্মার আমলে তাঁর সমর সচিব আশরাফ খানের তত্ত্বাবধানে কবি দৌলত কাজী ‘সতীময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্য রচনা করেন। কাছাকাছি সময়ে কবি মরদন রচনা করেন ‘নসীরানামা’। রাজা সাদ উমাদারের রাজত্বকালে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোশকতায় আলাওল তাঁর বিখ্যাত ‘পদ্মাবতী’ কাব্যটি রচনা করেন। এছাড়া রাজা চন্দ্র সুধর্মার সমর সচিব সৈয়দ মুহম্মদের আদেশে আলাওল ‘সপ্তপয়কর’, নবরাজ মজলিসের আদেশে ‘সেকেন্দারনামা’, মন্ত্রী সৈয়দ মুসার আদেশে ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ কাব্য রচনা করে মধ্যযুগের বাংলা কাব্যসম্ভারকে সমৃদ্ধ করেন। আরাকান রাজসভার খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসেবে কোরেশী মাগন ঠাকুর বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও রাজসভাসদ। তিনি ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্যের রচয়িতা ও কবি আলাওলের অন্যতম পৃষ্ঠপোশক হিসেবেও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এছাড়াও আরাকান রাজসভার সভাসদের আনুকূল্যে কবি আবদুল করীম খোন্দকার ‘দুল্লা মজলিস’ কাব্য রচনা করেন।
আরাকান রাজসভায় চর্চিত বাংলা কাব্যসাহিত্যের দুটি বিশেষ ধারা পরিলক্ষিত হয়। একটি ধর্মবিষয় সম্পৃক্ত, অন্যটি রোমান্টিক প্রণয়কাব্যের ধারা। ইসলাম ধর্মের সম্প্রসারণ ও উপলব্ধির যর্থাথ উপকরণ নিয়ে ধর্ম সংশ্লিষ্ট কাব্যগুলো রচিত হয়েছিল। অন্যদিকে প্রণয়ের উচ্ছ্বাস ও মানবিক সম্পর্কের বিষয় নিয়ে রোমান্টিক ভাবধারার কাব্যগাথা রচিত হয়। তবে একথা স্বীকার্য যে আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের যে বিকাশ সাধন হয়েছিল, তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। সেখানে বাংলা ভাষায় দক্ষ মুসলিম কবিগণ যে কাব্যধারার প্রবর্তন করেন, তা নিঃসন্দেহে মধ্যযুগের সাহিত্যের ইতিহাসে ছিল এক তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন। সুদূর আরাকানে ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন ধর্মের রাজাদের আনুকূল্যে বাংলা ভাষাভাষী কবিগণ যে কাব্যসাধনায় ব্যাপৃত হয়েছিলেন, তা সাহিত্যমূল্য ও ঐতিহাসিক বিবেচনায় বাঙালীদের জন্য ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। তাঁদের এ অবদান বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করাছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মধ্যযুগের ধর্মনির্ভর সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি তারা যে মানবিক সম্পর্কের সাহিত্য সাধনার সূচনা করেন, তা পরবর্তীকালে আধুনিক সাহিত্যের সূচনাবিন্দু হিসেবে বহুবিধ কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ কারণে বলা হয় আরাকান রাজসভায় মুসলমান কবিগণ কর্তৃক সৃষ্ট কাব্য ধারাটি মূল প্রবাহ থেকে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন হলেও তা সর্বজনীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবেই স্বীকৃত।
– dailyjanakantha থেকে।