LDC থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) তালিকা থেকে বের হওয়ার পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি কৌশল প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ১৯৭৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকাভূক্ত হওয়ার পর এই প্রথম অর্থনৈতিক সুসংবাদ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার জন্য মাথা পিছু আয়, মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অঙ্গুরতা এই তিন সূচকের যেকোন দুটিতে সিপিডি(Committee for Development policy) নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ তিনসূচকেই অগ্রগামী। মিয়ানমার ও একই যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিন্তু এই ধারাবাহিকতা আরও তিনি বছর অব্যহত রাখতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় তিন বছর পর ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য সুপারিশ করবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল(ECOSOC). আরও তিন বছর পর ২০২৪ সালে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেওয়া হবে। তবে স্বল্পোন্নত দেশের সব বাণিজ্য-সুবিধা ২০২৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আর ওষুধ শিল্পের মেধাস্বত্ব সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত থাকবে।

বাংলাদেশের অর্জন

২০১৮ সালে জাতিসংঘের Committee for Development policy(CPD) এর পর্যালোচনায় দেখা গেছে

  1. অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতায় থাকতে হয় ৩২ এর কম বাংলাদেশের ২৫.২
  2. মানব সম্পদ উন্নয়নে ৬৬ এর বেশি, বাংলাদেশের ৭৩.২
  3. মাথাপিছু আয় ১২৩০ ডলার বাংলাদেশের ১২৭৪,(জাতিসংঘের এ্যটলাস পদ্ধতিতে ) বাংলাদেশের হিসাবে বর্তমান- ১৭৫২ডলার

সিপিডি উপর্যুক্ত সূচকে বাংলাদেশের উত্তরণ কে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়েছে। এবং বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের জন্য মনোনীত করেছে। এর তিন বছর পর চূড়ান্ত সুপারিশ করবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল(ECOSOC)। এর তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মিলবে।

তাই ২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ EU তে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাবে। তাই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাজার সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

LDC থেকে উত্তরণে কিছু অসুবিধা

  • উচ্চ সুদে ঋণ
  • দাতাদের কাছ থেকে রেয়াতি সুদে ঋণ প্রাপ্তি কমে যাবে।
  • রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের আঘাত পড়বে। অর্থাৎ রপ্তানি খাতের বাজার সুবিধা সংকুচিত হয়ে যাবে।
  • এমন এক সময়ে বাংলাদেশ LDC থেকে বের হবে যখন বৈরী আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
  • বাণিজ্যসুবিধা কতটা কমবে
    স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে ইউরোপের ৪০টি দেশে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা পায়। উন্নয়নশীল দেশ হলে এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার প্রশ্ন উঠবে। তবে একতরফা, তাৎক্ষণিকভাবে এই সুযোগ শেষ হবে না, আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত হবে। দর-কষাকষির মাধ্যমে জিএসপি প্লাসে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
    প্রতিযোগীসক্ষম হলে যে টিকে থাকা যায়, এর অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশের আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা উঠে গেলেও বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে বাংলাদেশ। তবে রপ্তানি খাত এক পণ্যনির্ভর না হয়ে তৈরি পোশাকের মতো বিকল্প পণ্য তৈরি করার দিকে মনোযোগী হতে হবে।
  • রেয়াতি ঋণসুবিধা পাবে না
    এলডিসি হওয়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে দাতাদের দেশগুলোর কাছে রেয়াতি সুবিধা পায় না বাংলাদেশ। তবে কম মাথাপিছু আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) থেকে মাত্র দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে ঋণ পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ায় আগামী বছর থেকে আইডিএ জিএপি দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন বাংলাদেশ আর দশমিক ৭৫ শতাংশ বা রেয়াতি সুদে ঋণ পাবে না। আইডিএ জিএপি দেশ হিসেবে সুদের হার পড়বে প্রায় আড়াই শতাংশ। যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় আর বেড়ে চলেছে, তাই ঋণের সুদের হারও বাড়বে। তবে বাড়তি সুদে ঋণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। বাংলাদেশ যদি কোনো প্রকল্প সঠিকভাবে বিশ্বব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করতে পারে, তখন যত খুশি ঋণ নিতে পারবে।
    মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ইতিমধ্যে এডিবির কাছ থেকে সীমিত পরিসরে বেশি সুদের ঋণ নেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ।
    বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এলডিসি থেকে বের হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ। আরও বেশি অর্থ পাওয়ার জানালা খুলবে। যখন বাংলাদেশ বেশি সুদে ঋণ নেবে, তা আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সার্বভৌম বন্ড ছেড়ে অর্থ আহরণের সুযোগও তৈরি হবে।
  • সুরক্ষার ক্ষমতা কমতে পারে
    স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নিজের অভ্যন্তরীণ শিল্প সুরক্ষায় সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানোসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ সংকুচিত হতে পারে। ফলে বাংলাদেশের শিল্পকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আবার রাজস্ব আহরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক থেকে মোট রাজস্বের বড় অংশ আসে। গত অর্থবছরে শুধু সম্পূরক শুল্ক থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
    অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও জাহিদ হোসেন উভয়েই বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করা, শ্রমশক্তির মানোন্নয়ন।

চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা

বড় অর্জনে চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি তাই নিচের কৌশলগুলো নেওয়া যেতে পারে-

  • নিজস্ব উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি
  • সক্রিয় শ্রম শক্তি
  • বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো
  • বৈষম্য কমান
  • নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় বাড়াতে হবে।
  • সরকারি বিনিয়গ বাড়াতে হবে
  • টাকা পাচার রোধ করতে হবে।
  • অভ্যন্তরিণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করতে হবে।
  • অবকাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে হবে।
  • কর আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে।
  • বাংলাদেশ যদি কোনো প্রকল্প সঠিকভাবে বিশ্বব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করতে পারে, তখন যত খুশি ঋণ নিতে পারবে।

এ বছর বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তান আর মিয়ানমারও ‘উন্নয়নশীল’ দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। যদিও ২০২১ সালের মধ্যে সবগুলো পরীক্ষায় পাস হলেই কেবল ২০২৪ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া সম্ভব।

Paper Clipping

‘সব সমস্যা সমাধানের’ বিষয় নয়
উন্নয়নশীল না নিম্ন-মধ্যম আয়ের এলডিসি, তা নিয়ে বিভ্রান্তি

Add a Comment