সিরিয়া বিষয়ে কোন পথ বেছে নেবেন পুতিন?
|প্রথম আলো, ০৩ আগস্ট ২০১৮
হেলসিঙ্কির বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে আসলে কী কী বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে তা হয়তো আমরা কখনোই জানতে পারব না। তবে নানা কারণে এটা আমাদের কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে যে বৈঠকের প্রধান বিষয় ছিল সিরিয়া। প্রকৃতপক্ষে যেসব বিষয় ওয়াশিংটন ও মস্কোর সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলেছে (যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ, ইউক্রেনে দ্বন্দ্ব, ন্যাটোর সম্প্রসারণ ইত্যাদি), তার মধ্যে সিরিয়াই হয়তো সবচেয়ে সহজ বিষয়, যার মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।
ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত (আইএসআইএল) বা আইএসএইএসের পরাজয়ের পর ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ইচ্ছা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া নিয়ে প্রকৃত অর্থে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। সিরিয়ায় সংকট শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর কোনো রকম চাপ প্রয়োগ বা হস্তক্ষেপ করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিল। ইরাকের মসুল শহরের পতনের পর সেখানে খেলাফতের ঘোষণা এবং আইএসআইএলের কার্যক্রম বিস্তারের পর যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার যুদ্ধ শুধু আইএসআইএলের বিরুদ্ধে সীমিত রেখেছিল এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িত না হওয়ার বিষয়ে ওয়াশিংটন খুব সতর্ক ছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার বলেছেন যে আইএসআইএলের পরাজয়ের পর তিনি সিরিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি চান না। তিনি এও বলেছেন যে তিনি দেখতে চান যে ইরান সিরিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে দিয়েছে এবং আঞ্চলিক প্রভাব কাটছাঁট করেছে। কেবল রাশিয়ার সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এই দুটি উদ্দেশ্য সাধন করা যায়। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়া সিরিয়াকে সহযোগিতা করতে চায়। তবে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার চেয়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বজায় রাখাই হচ্ছে রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বমঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করে। বস্তুত প্রেসিডেন্ট পুতিন এর আগে তাঁর আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি অন্যান্য স্থানে প্রয়োগ করেছেন (২০০৮ সালে জর্জিয়ায় এবং ২০১৪ সালে ইউক্রেনে)। রাশিয়ার এসব ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগের পেছনে মূলত ছিল আত্মরক্ষা। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিষয়টি আত্মরক্ষামূলক নয়। এটা ছিল রাশিয়ার শীতল যুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন অঞ্চলগুলোর বাইরে ক্ষমতার প্রদর্শন। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ক্লান্তির সুযোগ নিয়ে পুতিন রাশিয়াকে বিশ্বশক্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
রাশিয়া সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শাসন বজায় রাখতে এবং মার্কিন সমর্থিত বিরোধীদের বিজয় প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। আসলে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফের নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করা। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার এক মেরুর বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেয়। আর এ লক্ষ্য অর্জনে ইরান ছিল তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
সিরিয়া সংকটের শুরু থেকে রাশিয়া আসাদের প্রশাসনকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে। এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র হিসেবে আরব বসন্তকে প্রতিহত করেছে রাশিয়া। রাশিয়ার আরব বসন্তবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও ২০১৫ সালের গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত (যখন বাশার আল-আসাদ ও তাঁর ইরান-সমর্থিত বাহিনী পরাজিত হয়েছে) রাশিয়াকে সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়নি।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে তেহরান ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ব্রিগেডের কমান্ডার জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে মস্কোয় পাঠান সিরিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে। তার আগে ইরান খুব আশাবাদী ছিল যে এর আগের মাসে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নত হবে আর এর ফলে বাশার আল-আসাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে সহজ হবে। কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তুরস্ক ও সৌদি আরব সিরিয়ার বিরোধীদের প্রতি সমর্থন বাড়িয়ে দিয়েছিল, আর ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির পর সিরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। রাশিয়া তখন ইরানের অনুরোধে রাজি হয় এবং সিরিয়ার যুদ্ধে দেশ দুটি একটি কার্যকর জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইরান সিরিয়ায় সৈন্য পাঠায় এবং রাশিয়া বিমান থেকে নিক্ষেপের জন্য বোমা সরবরাহ করে।
এখন পর্যন্ত রাশিয়ার দৃষ্টিতে সিরিয়া যুদ্ধে ইরান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। সিরিয়ায় পশ্চিমা সমর্থিত বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে, তুরস্ক ও আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর বিজয়ী হওয়া প্রতিহত করতে এবং রাশিয়ার মিত্র লিবিয়ায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপের প্রতিশোধ নিতে ইরান রাশিয়াকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। ইরানের সাহায্যে এসব করার পর দুই মিত্রের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। এখন রাশিয়া চায় সিরিয়ায় তার অর্জনকে ইউক্রেন ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ মৌলিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে। আর ইরান চায় সম্ভাব্য মার্কিন বা ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে সিরিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতিকে বাড়াতে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল চায় সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব কমাতে। এ ক্ষেত্রে পুতিনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যদি পুতিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ইরানের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। আর তিনি যদি ইরানের সঙ্গে তাঁর জোট ধরে রাখতে চান তাহলে ইরানের প্রভাবকে কমানোর জন্য ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের চেষ্টা ব্যর্থ হবে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকেই সহযোগিতা করবেন। তবে তা করবেন কেবল রাশিয়ার ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরই। ইউক্রেন দখলকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। পুতিন শেষ পর্যন্ত কী করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। আল-জাজিরা থেকে নেওয়া
মারভান কাবালান সিরীয় শিক্ষাবিদ ও লেখক