ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া ভালো
|ওআইসি সম্মেলন
প্রথম আলো, ১৫ মে ২০১৮
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক
যত শক্তিশালী রাষ্ট্রই হোক, এ কালে সব রাষ্ট্রকেই ছোট-বড় সব দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক না রেখে উপায় নেই। প্রতিবেশী এবং বিশেষ বিশেষ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে হয় রাজনৈতিক স্বার্থে, অর্থনৈতিক স্বার্থেও। বাংলাদেশের মতো ১৬-১৭ কোটি মানুষের দেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশও অর্থনৈতিক স্বার্থে সুসম্পর্ক রাখতে আগ্রহী।
আমরা সেই সময় সরকারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, সেটি ছিল জাতির জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। মুক্তিযুদ্ধে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব বিরোধিতা করেছে। এদিকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষে। অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা করেছে, প্রত্যক্ষ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা না করে শুধু মৌখিক নিন্দা-প্রশংসায় কিছুই যে আসে-যায় না, তা রোহিঙ্গা সংকটের পর বাংলাদেশের মানুষের বুঝতে বাকি নেই। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সে সময়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিকদের দক্ষতার প্রশংসা না করে উপায় নেই। সে সময় শুধু বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি নয়, জাতিসংঘের সদস্য হওয়া এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) প্রভৃতির সদস্য হওয়া ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় আহত ও লজ্জিত হয়েছি। গত সপ্তাহে ঢাকায় ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫ তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। ওই সম্মেলনে ওআইসির সহকারী মহাসচিব পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই পদে এশিয়া মহাদেশ থেকে মোট ভোট ছিল ১৮। বাংলাদেশ নিজের ভোটসহ পেয়েছে ৬ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী কাজাখস্তান ১২ ভোট পেয়ে এই পদে নির্বাচিত হয়েছে। গোপন ব্যালটে নির্বাচন হয়। ঘটনাটি ঢাকায় ঘটেছে বলে আরও বেশি লজ্জার। এক-দুই ভোট নয়, এত ভোটে পরাজয় অবিশ্বাস্য।
ওআইসিতে বাংলাদেশের সদস্য হওয়া ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আমরা তার সাক্ষী। এই প্রজন্ম তা জানে না। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তা ছিল এক নাটকীয় ঘটনা এবং সেই নাটকের প্রধান চরিত্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। চুয়াত্তরের ফেব্রুয়ারিতে ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন হবে লাহোরে। দুই বছরের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে তার কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই। কিন্তু ওআইসির প্রধান নেতারা চান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি সংগঠনের সদস্য হোক। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন তাঁর ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ দিয়ে কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাবাহ আল সাবাহ এবং ওআইসির দূত তোয়ামি আজ্জালিকে ঢাকায় পাঠান। সারা রাত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওদিকে ওআইসির নেতারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকেও চাপ দেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সবচেয়ে তাৎপর্যের ব্যাপার, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়াকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানান।
স্বীকৃতির পরই শুধু বঙ্গবন্ধু লাহোরে যেতে সম্মত হন। সেটি ছিল বাংলাদেশের ষোলোই ডিসেম্বরের পরে দ্বিতীয় বিজয়। আমার যতটা স্মরণ আছে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজেই লাহোর গিয়েছিলেন, বুমেদিনের পাঠানো প্লেনে নয়। লাহোর বিমানবন্দরে বাংলাদেশের নেতাকে স্বাগত জানান পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে পাঞ্জাবের মন্ত্রী ও বিখ্যাত ক্রিকেট ক্যাপ্টেন আবদুল হাফিজ কারদার।
১৯৭৪ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্সটারনাল পাবলিসিটি উইংয়ের সহযোগিতায় প্রকাশিত বুলেটিন বাংলাদেশ নিউজ সম্পাদনা করেছি। তাই সে সময়ের কথা মনে আছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সে সময়ের পদস্থ কূটনীতিকদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের কূটনৈতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে দেশাত্মবোধ ছিল। আলজিয়ার্সের শীর্ষ সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ন্যামের সদস্য হওয়া থেকে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ পর্যন্ত বিভিন্ন তৎপরতায় সেদিনের কূটনীতিকদের ভূমিকা ভুলে যাওয়ার নয়। আরশাদ-উজ জামান, আতাউল করিম, আবুল আহসান, জাতিসংঘ ডেস্কের রিয়াজ রহমান, বেলগ্রেডে রাষ্ট্রদূত ও আর এস দোহা, ফারুক সোবহান, ফখরুদ্দীন আহমদ, জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার আগে সেখানে পারমানেন্ট অবজারভার সৈয়দ আনোয়ারুল করিম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
এবার সহকারী মহাসচিব পদে কাজাখস্তানের কাছে বাংলাদেশের বিব্রতকর পরাজয় ঘটেছে এবং সেটা ঢাকা সম্মেলনে। সে জন্য আরও বেশি লজ্জার। ‘ঢাকায় এবারের ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক আয়োজন এবং সহকারী মহাসচিব পদে বাংলাদেশের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাতে বিভিন্ন দেশ সফর করতে ১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানা গেছে।’ [যুগান্তর] টাকাটা স্রেফ পানিতে গেল।
কী কারণে এমনটি ঘটেছে, তার কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। ওআইসিতে বাংলাদেশের এই পরাজয়ের মধ্যে একটি বার্তা রয়েছে। ভুল এবং দুর্বলতাকে গোপন না করে সেই বার্তা যদি নীতিনির্ধারকেরা অনুধাবন করতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে।