ট্রাম্পের হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলে চলবে না
|প্রথম আলো, ২১ মে ২০১৮
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মাইকেল পেমব্রুক: নিউ সাউথ ওয়ালশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক
গত সপ্তাহে খুব দুশ্চিন্তায় ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। উত্তর কোরিয়া নয়; বরং আমেরিকাই কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার সম্ভাবনাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এই এতগুলো বছর পর উত্তর কোরিয়া যখন প্রথমবারের মতো আন্তরিকভাবে সমঝোতা বৈঠকে বসতে চাইছে, তখন সেই সুযোগ হাতছাড়া করা নিঃসন্দেহে বিরাট ভুল হবে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই যেমনটা বলছিলেন, ‘শান্তির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের এই সুযোগটিকে পরিচর্যা করা উচিত।’
যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার সম্মেলনটি যখন নির্ধারিত হয়েছে, ঠিক তার আগমুহূর্তে ২০০৩ সালে স্বাক্ষরিত লিবিয়ার নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি এবং গাদ্দাফির করুণ পরিণতির প্রসঙ্গ সামনে আনা সাংঘাতিক সংবেদনহীন ও অদূরদর্শী কাজ। এসব অপ্রিয় প্রসঙ্গের অবতারণা সম্ভাব্য সম্মেলনকে কেবল ক্ষতিই করতে পারবে।
কোরীয় উপদ্বীপে কয়েক দশক ধরে চলা উত্তেজনা প্রশমনের বিরাট সুযোগ ট্রাম্প প্রশাসনের সামনে এসেছে। কোনো কু উপদেশে কান দিয়ে তাদের এমন সুযোগকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। পিয়ংইয়ং খুবই যৌক্তিক দাবি নিয়ে আলোচনায় উদ্যোগী হয়েছে।
গত ৬ মার্চ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের মারফত কিম জং-উন তাঁর অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে সামরিক হুমকি যদি সরিয়ে নেওয়া হয় এবং তাঁর নিরাপত্তা যদি নিশ্চিত করা হয়, তাহলে তাঁর পরমাণু অস্ত্র রাখার কোনো কারণ নেই। আলোচনার টেবিলেও এটিই উত্তর কোরিয়ার দেওয়া প্রস্তাব। কিন্তু ট্রাম্পকে যাঁরা উপদেশ দিচ্ছেন, তাঁরা সেটি দেখতে পাচ্ছেন কি না, সেটিই বোঝা যাচ্ছে না।
একটি শান্তিচুক্তির তাৎপর্য ও প্রতীকী গুরুত্ব বেইজিং ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে। বেইজিং বারবার যুক্তরাষ্ট্রকে কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করা এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে এগোনোর জন্য বলে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি উত্তর কোরিয়াকে একতরফাভাবে পরমাণু অস্ত্র পরিত্যাগ করতে বলে, তাহলে কোনো চুক্তি হবে না। পিয়ংইয়ং বরাবরই বলে আসছে, তারা এমন কতকগুলো শর্তসংবলিত চুক্তির মাধ্যমে পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি আছে, যে চুক্তিটি পুরো অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে। চীনের সি চিন পিং এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মুন জে-ইনের চাওয়াও তা-ই।
এ কারণে দেশটি একতরফাভাবে তার এত দিনের অস্ত্র কার্যক্রম কোনো রকম নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়াই গুটিয়ে নেবে, সেটা ভাবা বোকামি হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এটি এখন একটি পারমাণবিক ক্ষমতাধর দেশ। অতীতের পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে আজকের পিয়ংইয়ংয়ের আকাশপাতাল তফাত। এ ছাড়া পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ীই কিম জং-উন তাঁর বাবা কিম জং-ইলের চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী, অনেক বেশি স্মার্ট ও আধুনিক।
এ অবস্থায় উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার একমাত্র পথ হলো, তার ওপর থেকে স্থায়ীভাবে সামরিক হুমকি সরিয়ে নিয়ে তাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটানো। ট্রাম্পের উপদেষ্টারা তাঁকে কু উপদেশ না দিলে অথবা তিনি তাঁদের সেই উপদেশে কান না দিলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সমঝোতা হতে পারে।
কিন্তু এক বছর পর জেনেভা কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দেয়, তারা এ ধরনের কোনো চুক্তিতে যাবে না। কমিউনিস্টবিরোধী হিসেবে পরিচিত তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফস্টার ডুলেস চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে তাঁকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যান। তখন থেকেই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনা ঝুলে আছে।
২০১২ সালের শুরুতে কিম জং-উন উত্তর কোরিয়ার নেতা হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি অনুষ্ঠানে শান্তি আলোচনার কথা বলেছেন। এখন সে ধরনের একটি আলোচনার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। কিন্তু ভয়ের ব্যাপার হলো, আলোচনায় বসার আগেই উত্তর কোরিয়াকে যথার্থ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া ছাড়াই তাকে একতরফাভাবে পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে।
ওয়াশিংটনকে দ্রুত এই অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। নয়তো ট্রাম্প-উনের বৈঠকের সম্ভাবনা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আর সত্যিই এই বৈঠক ভেস্তে গেলে কোরীয় উপদ্বীপের জন্য বড় বিপদ নেমে আসবে। সেই বিপদ থেকে যুক্তরাষ্ট্রেরও রেহাই পাওয়া কঠিন হবে।