গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে জাতিসংঘ ফোরামের উদ্বেগ
|প্রথম আলো, ১৫ মে ২০১৮
বিশেষ প্রতিনিধি, জেনেভা থেকে
- মানবাধিকার পর্যালোচনা
- রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশ প্রশংসিত।
- প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক বিধানগুলো নিয়ে উদ্বেগ।
- আগামী নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার তাগিদ।
গতকাল সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনা বা ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউর তৃতীয় দফার আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে আগামী নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করার তাগিদ এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, জাপানসহ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা অবাধ, স্বচ্ছ এবং সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
সভায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশ সবার প্রশংসা পেয়েছে। আলোচনায় ৯৫টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। লক্ষণীয়ভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বৌদ্ধপ্রধান জনসংখ্যার দেশগুলো (যেমন জাপান, চীন ও থাইল্যান্ড) মিয়ানমার থেকে আগতদের ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয় ব্যবহার করেনি এবং তারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়েছে।
প্রায় কুড়িটির মতো দেশের প্রতিনিধিরা গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব বেআইনি কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তের সুপারিশ করেন। জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যে মাত্রায় গুমের কথা বলা হচ্ছে তাতে আপত্তি আছে। ২০১৩ সালে দ্বিতীয় ইউপিআরে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে গুম বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আনিসুল হক এবার তা পুরোপুরি নাকচ না করে বলেন, গুম সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত অপপ্রচারের রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ গুম হয়েছেন বলা হলেও তাঁকে ভারতে পাওয়া গেছে। হুম্মাম কাদের চৌধুরী, মুবাশ্বির হাসান, সাংবাদিক উৎপল দাসসহ অনেকেই ফিরে এসেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেগুলোকে গুম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী জাতিসংঘের গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করার কথাও বলেছেন।
রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের অধিকার ও নির্বাচনবিষয়ক উদ্বেগের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর জন্য বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতায় অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণহানির কথা উল্লেখ করেন। ২০১৫ সালেও অবরোধ-হরতালের নামে ১০৮ জন নিহত হওয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি।
সভায় সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা, হয়রানি ও হুমকির কারণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অনলাইন-অফলাইন সব জায়গায় এসব বাধা দূর করার আহ্বান জানান। সবাই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক বিধানগুলো বাতিলের কথা বলেন। আইনমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, ৫৭ ধারা অপপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠায় তা বাতিল করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা নিয়ে আপত্তি উঠেছে, সেগুলো নিয়ে সরকার সবার সঙ্গে আলোচনা করছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সব ধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষার প্রশ্নটিও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সভায় উত্থাপন করেন। সমকামিতা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার যে আইন রয়েছে, সেটিও সংশোধনের সুপারিশ করেছে বেশ কয়েকটি দেশ। ইউপিআরে অংশগ্রহণকারীরা বাল্যবিবাহ নিরোধক আইনে বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাড় দেওয়ার বিধান বাতিল করে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার কথা বলেছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধের অভিযোগ তদন্তে কমিশনকে ক্ষমতায়িত করার ওপর জোর দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। সভায় এ বিষয়ে ব্যাপক সমর্থন লক্ষ করা যায়। মানবাধিকারকর্মীদের কাজ নির্বিঘ্ন করতে তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া, তাঁদের ওপর বিভিন্ন হামলা ও হয়রানির অভিযোগ তদন্ত করা এবং বিদেশি অনুদান আইন সংশোধনেরও জোরালো আহ্বানের কথা শোনা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশি অনুদান আইন ব্যবহার করে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।
আইনমন্ত্রী অবশ্য এ অভিযোগের জবাবে বলেছেন, অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ, কালোটাকা সাদা করা এবং সন্ত্রাসের অর্থায়ন বন্ধের লক্ষ্যেই বিদেশি অনুদান আইন করা হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ বা স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারদের বাংলাদেশ সফরের সুযোগ দেওয়ার জন্য অনেক দেশের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হলেও আইনমন্ত্রী বিষয়টিতে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারদের অনুরোধ প্রায় এক দশক ধরে সিদ্ধান্তহীনভাবে পড়ে আছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের যেসব সনদ বা ঘোষণা ও নীতিমালা এবং আনুষঙ্গিক বা অতিরিক্ত প্রটোকল বাংলাদেশ এখনো অনুমোদন করেনি, সেগুলো গ্রহণের আহ্বানের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নয়টি সনদের আটটিতে স্বাক্ষর করেছে। অতিরিক্ত আন্তর্জাতিক দায় গ্রহণের আগে এখন প্রয়োজন সক্ষমতা ও সামর্থ্য বাড়ানো।
আলোচনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন শাক্তিশালী করার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক। ইউপিআরে গুমের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো নাগরিক নিখোঁজ অথবা গুম হলে তাঁকে উদ্ধার এবং রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যাঁরা ফিরে এসেছেন বলা হচ্ছে, তাঁদের বেলায় কী ঘটেছিল তা এখনো জানা যায়নি এবং কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে সেই অপরাধীরও বিচার হয়নি।
ইউপিআরে উত্থাপিত সুপারিশগুলোর খসড়া প্রকাশ করা হবে বুধবার এবং আগামী বৃহস্পতিবার তা অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে।
👉 Read More...👇