উন্নয়নশীল না নিম্ন-মধ্যম আয়ের এলডিসি, তা নিয়ে বিভ্রান্তি
|প্রথম আলো, ২৫ মার্চ ২০১৮
ফখরুল ইসলাম, ঢাকা
বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ কি না, তা নিয়ে সাধারণ্যে বিভ্রান্তি আছে। শিক্ষিত সমাজও বিভ্রান্ত।
নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে তিন বছর আগেই। ২০১৫ সালের ১ জুলাই এ ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। আর চলতি মাসে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা। এই ঘোষণা জাতিসংঘের।
কিন্তু নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ কী, আর উন্নয়নশীল দেশইবা আসলে কী? বাংলাদেশ যে নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, তা শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ এখনই হয়ে যায়নি। ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ’—এ ঘোষণা আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। ঘোষণাটি দেবে জাতিসংঘ। তার পরের তিন বছর, অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে একটি কৌশলপত্র তৈরি করে বাংলাদেশ তা বাস্তবায়ন করবে।
বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি আছে এমনকি শিক্ষিত সমাজেও। তাও আবার কয়েক ধরনের বিভ্রান্তি। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ কি এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেছে, না হতে যাচ্ছে? নাকি বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ? মধ্যম আয়ের দেশেরও যেহেতু ভাগ রয়েছে দুটি, বাংলাদেশ তাহলে কোনটি-নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ, না উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ?
এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-আমলারাও প্যাঁচে রয়েছেন। মন্ত্রীরা প্রায়ই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বলে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কিন্তু খোলাসা করে বলছেন না যে তা নিম্ন-মধ্যম, না উচ্চ-মধ্যম আয়ের? আরেকটা প্রশ্নও উঠছে নতুন করে। ১৯৮০ বা ১৯৯০ দশকেই যে স্কুল-কলেজে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলা হতো, সেটা তাহলে ভুল ছিল? আসলে তখন আমরা জাতিসংঘের হিসাবে এলডিসি এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন আয়ের দেশ ছিলাম। একটু আগ বাড়িয়ে তখন কেউ কেউ উন্নয়নশীল বলে ফেলতেন।
‘এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের অভিযাত্রায় বাংলাদেশ’ নামে গত বৃহস্পতিবার থেকে দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠান চলছে। তা আরও চলবে। গত বৃহস্পতিবার অন্যদের মতো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রায় সব কর অঞ্চলই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে। দেখা যায়, ব্যানারগুলোতে প্রায় একই লেখা, ‘নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনে সাফল্য উদ্যাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা’।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অবশ্য মনে করেন, কেউ কেউ গুলিয়ে ফেললেও অনেকে ইচ্ছা করেও বাড়িয়ে বলছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের এলডিসি, আরও ছয় বছর তা-ই থাকবে। ২০২৪ সালে জাতিসংঘ যদি ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ তখন হবে নিম্ন-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ।
জাতিসংঘের হিসাব
জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে তিন ধরনের দেশ রয়েছে-উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত (এলিডিসি)। জাতিসংঘ হিসাবটি করে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা বা সংকট সূচক অনুযায়ী। জাতিসংঘের ১৯৭১ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে এলিডিসি ছিল ২৩ টি, বর্তমানে ৪৭। বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে।
মাত্র পাঁচটি দেশ গত ৪০ বছরে এলডিসি থেকে বের হতে পেরেছে। এর মধ্যে বতসোয়ানা ১৯৯৪, কেপ ভার্দে ২০০৭, মালদ্বীপ ২০১১, সামোয়া ২০১৪ এবং ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ২০১৪ সালে বের হয়। ২০১১ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এলডিসিবিষয়ক চতুর্থ জাতিসংঘ সম্মেলনে ২০২০ সালের মধ্যে এলডিসির সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। সামনেই ২০২০। অর্থনীতিবিদেরা আপাতত এ লক্ষ্য পূরণের সম্ভাবনা দেখছেন না।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব
কোন দেশ কতটা ধনী বা গরিব, সেটাকে বিশ্বব্যাংক নিজের মতো বিবেচনা করে। মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় দিয়ে বিবেচনা করা বিশ্বব্যাংকের ভাগগুলো এক হিসাবে তিনটি, আরেক হিসাবে চারটি। তিনটি ভাগ এ রকম—নিম্ন আয়, মধ্যম আয় এবং উচ্চ আয়ের দেশ। মধ্যম আয় আবার দুই রকম—নিম্ন-মধ্যম আয় এবং উচ্চ-মধ্যম আয়। সে হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের মধ্যে আছে।
বাংলাদেশ যে নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, সে ঘোষণা বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ২০১৫ সালের ১ জুলাই। যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় সেগুলোই হচ্ছে নিম্ন আয়ের দেশ। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫ সালের ১ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ ছিল। নিম্ন আয়ের দেশকে সহজ বাংলায় বাঙালিরা গরিব দেশ বা দরিদ্র দেশ বলে আসছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত সবাই মধ্যম আয়ের দেশ। এর মধ্যে আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ পর্যন্ত হলে তা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ, আর ৪ হাজার ১২৬ থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত হলে সেটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ। মাথাপিছু জাতীয় আয় এর চেয়ে বেশি হলেই হবে উচ্চ আয়ের দেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে নিম্ন আয়ের দেশ ৩১টি, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ ৫২টি, উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ ৫৬টি এবং উচ্চ আয়ের দেশ ৮০টি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মাথাপিছু আয় ২০২৮ সালে দ্বিগুণ হলেও আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশই থাকব। কারণ, ১০ বছরেই তো মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ১২৬ ডলারে নিয়ে যেতে পারব না।’