ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

আইনের শাসন ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উপযুক্ত আইন আবশ্যক। রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে অনেক আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করে।

২০১৮, ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ -এর খসড়া অনুমোদন করে। ৯ এপ্রিল সেটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি মানুষের হাতের মধ্যে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। অপরাধপ্রবণ ও অশুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আমাদের সমাজে বিরল নয়। সে জন্য একটি আইন থাকা দরকার বলে সরকার মনে করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া রচনা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে একটি আইন ২০০৬ সালে করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে সেটিতে শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হয়। এবারেরটি আরও কঠোর। বিশেষ করে সেটির ৫৭ ধারার সমালোচনা করেন গণমাধ্যমসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। ৫৭ ধারায় ছিল মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চক্রান্ত প্রভৃতি অবাধে কঠোর শাস্তির বিধান। জনমতের চাপে সরকার ৫৭ ধারা বাতিল করে। কিন্তু বর্তমান সংশোধিত বিলটিতে ৩২ ধারায় যা আছে, তা স্বাধীন মতপ্রকাশ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বিষাক্ত কাঁটাবিশেষ।

অনুমোদিত খসড়ার ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ-প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজই বিভিন্ন উপায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা, জাতীয় স্বার্থে ও জনস্বার্থে সত্য খুঁজে বের করে পাঠককে জানানো। গুপ্তচর শব্দটি খুবই অবমাননাকর। গুপ্তচর হলো সেই ব্যক্তি, যে কারও দ্বারা নিযুক্ত হয়ে শত্রুর গোপন কথা জানার চেষ্টা করে। সাংবাদিক তা করেন না। তিনি কোনো ব্যক্তির এজেন্ট নন। গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করাতে তাঁর নিজের বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের কোনো স্বার্থ নেই। গণতন্ত্রে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার।

প্রস্তাবিত আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রচারণা চালালে বা তাতে মদদ দিলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

এই সব ধারার কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশের মাটিতে বসে কেউ বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার আগ্রহ দেখাবেন না। কোনো ব্যক্তিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। মহাত্মা গান্ধীর যৌনজীবন নিয়েও বই লেখা হচ্ছে। কোনো মানুষ তাঁর মহৎ কর্মটির জন্যই চিরস্মরণীয় ও শ্রদ্ধেয়। তাঁর কোনো দুর্বল দিক আলোচনা করলে তার মহত্ত্ব ক্ষুণ্ন হয় না। বরং বাধা দিলে নেতিবাচক দিক বেশি আলোচিত হয়।

দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ একসঙ্গে ১ কোটি টাকা চোখে দেখেনি। কোনো একটা মতামত প্রকাশের জন্য কাউকে ১ কোটি টাকা জরিমানা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা লোপাট করে যাঁরা বুক ফুলিয়ে সভা-সেমিনার করে বেড়ান, রাষ্ট্র তাঁদের জেলে ঢোকাতে পারে না। আর কোনো মন্তব্যের জন্য এমন সর্বোচ্চ শাস্তি!

এই আইন বলবৎ হলে সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদকের মাথার ওপরে খাঁড়া ঝুলে থাকবে। সেই উদ্বেগ থেকেই গত বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের নেতারা। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বৈঠকে বলেন, তাঁদের উদ্বেগ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১,২৫, ২৮,৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা নিয়ে। এই ধারাগুলো বাক্স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাঁদের বক্তব্য শুনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আপত্তিগুলো ‘অনেকাংশে যৌক্তিক’।

জনগণের প্রতিনিধিদের যাঁরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরাই ১৯৭২-এ সংবিধান দিয়ে গেছেন। সংবিধান হলো রাষ্ট্রের মৌলিক ও সর্বোচ্চ আইন। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আইনের শাসনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হচ্ছে সংবিধান। সেই সংবিধানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে। এর অর্থ হলো এই যে জনগণের জন্য কল্যাণকর আইন রচিত হবে এবং সেই আইনের সুফল সবাই ভোগ করবে।

TIB প্রধান ইফতেকারুজ্জামান বলেন, যৌক্তিক বাঁধা নিষেধ সাপেক্ষে সংবিধান মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা দিয়েছে, তা তথ্যপ্রযুতি আইনের ৫৭ ধারার কাছে অসহায়। আর মন্ত্রীসভা অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সব নাগরিকের বাক্‌ ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৪৩, ও ৫৮ ধারাগুলো দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা ও গণতন্ত্রের পাতিষ্ঠানিকীকরণের সম্ভাবনাকে ঝুঁকিতে ফেলবে।

জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্ক সংবাদ মাধ্যমের বৈশ্বিক প্রবণতা বিষয়ের প্রতিবেদন- Worlds Trends in Freedom of Global Expression and Media Development Report-2017-18, এ প্রতিবেদনের প্রথম বাক্যটি ছিল Jouranalism Under fire- সাংবাদিকতা তোপের মুখে।

প্রথম আলো থেকে।


👉 Read More...👇
🡸 🡺

Add a Comment