পুঁথি সাহিত্য
|প্রাচীন যুগে যাকে বলা হতো ‘পুস্তক’। মধ্যযুগে তাকেই বলা হত পুঁথি। সে হিসাবে আজকের বই বা বহি তখনার পুঁথি। আর এই পুস্তক শব্দটি এসেছে ‘পোস্ত’ বা ‘পুস্ত’ থেকে। যার অর্থ চামড়া। চামড়া বা পুস্ত-এর ওপর লেখা হতো বলে প্রাচীন সাহিত্যে একে পুস্তক বলা হতো। ‘পুস্তক’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত। আর এই সংষ্কৃত ‘পুস্তক’ থেকে পুঁথি শব্দটি এসেছে। এই পুঁথি প্রাকৃত ভাষায় ‘পুত্থিয়া’ হিন্দিতে ‘পোথী’ অসমিয়ায় ‘পুথী’ বাংলায় ‘পুঁথি’ হিসেবে পরিচিত। পুঁথি আর পুস্তক শব্দ দুটো সমার্থক।
শব্দসম্ভার ও ভাষারীতি লক্ষ করে বিভিন্নজন পুঁথিসাহিত্যের বিভিন্ন নামকরণ করেছেন। রেভারেন্ড জেমস লং এ ভাষাকে বলেছেন ‘মুসলমানি বাংলা’ আর এ ভাষায় রচিত সাহিত্যকে অভিহিত করেছেন মুসলমানি বাংলা সাহিত্য হিসেবে। কলকাতার বটতলার ছাপাখানার বদৌলতে প্রচার লাভ করে বলে এগুলো ‘বটতলার পুঁথি’ নামেও পরিচিত হয়। ভাষাবৈশিষ্ট্য ও বাক্যরীতির দিক থেকে বিচার করে প্রথমে এগুলোকে দোভাষী পুঁথি এবং পরবর্তীকালে ‘মিশ্রভাষারীতির কাব্য’ বলে অভিহিত করা হয়। দোভাষী পুঁথিকারদের সাধারণভাবে ‘শায়ের’ বলা হয়। ‘শায়ের’ আরবি শব্দ, যার অর্থ কবি।
“দোভাষী পুঁথি” বলতে বুঝায় কয়েকটি ভাষার শব্দ ব্যবহার করে মিশ্রিত ভাষায় রচিত পুঁথি। মনে রাখতে হবে “দোভাষী পুঁথি” শুধু দুটি ভাষায় রচিত পুঁথি না। বাংলা, হিন্দি, ফারসি, আরবি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার সংমিশ্রণে রচিত পুঁথিই হলো দোভাষী পুঁথি।
বিষয় ও রস বিচারে পুঁথিসাহিত্যকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায় :
১. রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য: ইউসুফ-জুলেখা, লায়লী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, গুলে বকাওলী, বেনজির-বদরে মুনীর প্রভৃতি। এগুলোতে আরব-ইরান-ভারতের পৌরাণিক ও কাল্পনিক আখ্যান অবলম্বনে নরনারীর প্রেমের বিবরণ আছে।
২. জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্যঃ আমির হামজা, সোনাভান, জৈগুনের পুঁথি, হাতেম তাই প্রভৃতি। এগুলিতে আরব-ইরানের ইসলামপূর্ব ও ইসলাম-উত্তর যুগের বীরপুরুষদের যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যজয় ও ইসলাম প্রচারের বর্ণাঢ্য বিবরণ আছে।
৩. নবী-আউলিয়ার জীবনীকাব্যঃ ঐতিহাসিক নবী, পীর, আউলিয়ার জীবনকথা, চরিত্র-মাহাত্ম্য ও ধর্মপ্রচার নিয়ে এ শ্রেণির কাব্য রচিত হয়েছে। কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া, হাজার মসলা প্রভৃতি কাব্য এর অন্তর্ভুক্ত।
৪. লৌকিক পীরপাঁচালিঃ হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে কাল্পনিক মুসলমান পীর-ফকিরের বিরোধ, যুদ্ধ এবং পরিণামে মিলন ও প্রতিষ্ঠালাভের কাহিনী বর্ণনা করে এই শ্রেণির কাব্য রচিত হয়েছে- যেমন সত্যপীরের পাঁচালি, গাজীকালু চম্পাবতী, বনবিবির জহুরনামা, লালমোনের কেচ্ছা প্রভৃতি।
৫. ইসলামের ইতিহাস, ধর্ম, রীতিনীতি বিষয়ক শাস্ত্রকাব্যঃ নসিহতনামা, ফজিলতে দরুদ ইত্যাদিতে ইসলামের আচরণবিধি ও নীতি-উপদেশ বর্ণিত হয়েছে।
৬. সমকালের ঘটনাশ্রিত কাব্যঃ সমকালের হাজি শরিয়তুল্লাহর মতো চরিত্র এবং ওহাবি-ফরায়েজির মতো ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে স্বল্পসংখ্যক হলেও কিছু কাব্য রচিত হয়েছে।
- ব্যতিক্রম ছাড়া পুঁথিসাহিত্যের কোনো রচনাই মৌলিক নয়।
- “ফকির গরীবুল্লাহ” কে দোভাষী পুঁথি সাহিত্য সার্থক ও জনপ্রিয় কবি বলা হয়।
- ফকির গরীবুল্লাহ, শাহ মুহম্মদ সগীর, আবদুল হাকিম তিনজনেই আলাদা আলাদা করে রচনা করেছেন ইউসুফ জোলেখা।
- ‘পদ্মাবতী’ – আলাওল
- ‘লাইলী মজনু’ – দৌলত উজির বাহরাম খান।