১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: প্রেক্ষাপট, প্রার্থী, এবং ফলাফল
১৯৬৫ সালের পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ক্ষমতা আরো সুসংহত হয় এবং এই নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের জন্য বাঙালির দাবিকে প্রভাবিত করে। এই নির্বাচন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের সংকটকেও তীব্রতর করে। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন, বিশেষ করে এর প্রেক্ষাপট, প্রার্থী, এবং ফলাফল সম্পর্কে।
১. প্রেক্ষাপট: রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজনের কারণ
- আইয়ুব খানের সামরিক শাসন: ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর, আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন এবং ১৯৬২ সালে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টশাসিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং আইয়ুব খান নিজেই রাষ্ট্রপতি হন।
- মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা: আইয়ুব খান সরাসরি নির্বাচনের পরিবর্তে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেন। এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণের পরিবর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন। এটি কার্যত ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে এবং সাধারণ জনগণের ভোটাধিকারের সুযোগ হ্রাস করে।
- বিরোধী দলের ক্রমবর্ধমান চাপ: আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে এবং বিরোধী দলগুলো তার শাসনব্যবস্থার প্রতি প্রশ্ন তুলে। এর ফলে আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালে একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন, যাতে তিনি তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
২. নির্বাচনের প্রার্থী
- মৌলানা আবুল আলা মওদুদী (জামাতে ইসলাম): জামাতে ইসলাম নেতা মওদুদী একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়ান। তার দল মূলত ইসলামিক নীতির উপর ভিত্তি করে শাসনব্যবস্থার সংস্কার দাবি করে।
- জুনাগড় নবাব (অবশ্যই উল্লেখযোগ্য): পাকিস্তানের অন্যান্য প্রার্থীও ছিলেন যারা বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতেন।
- ফাতেমা জিন্নাহ (বিরোধী প্রার্থী): মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ ছিলেন আইয়ুব খানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী। ফাতেমা জিন্নাহ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠার এবং সামরিক শাসনের অবসান চেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষত তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।
৩. নির্বাচনের প্রচারণা ও নির্বাচন পরিচালনা
- প্রচারণা: আইয়ুব খান প্রচারণার সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক প্রচার চালান। তিনি উন্নয়নমূলক কাজ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রধান প্রচারণার বিষয়বস্তু করেন। ফাতেমা জিন্নাহ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারণা চালান এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশব্যাপী সমর্থন পান।
- নির্বাচনী ব্যবস্থা: মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার অধীনে প্রায় ৮০,০০০ নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন যারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন। এর ফলে সাধারণ জনগণ সরাসরি ভোট দিতে পারেনি এবং নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে।
৪. নির্বাচনের ফলাফল
- আইয়ুব খানের বিজয়: নির্বাচনের ফলাফলে আইয়ুব খান জয়ী হন। তিনি মোট ভোটের প্রায় ৬৪% পান, যা তাকে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
- ফাতেমা জিন্নাহর পরাজয়: ফাতেমা জিন্নাহ ভোটের মাত্র ৩৬% পান এবং পরাজিত হন। তবে নির্বাচনের ফলাফলের পরপরই ব্যাপক প্রতারণা এবং কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ফাতেমা জিন্নাহর পরাজয় বাঙালি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ আরও তীব্র হয়।
৫. নির্বাচন পরবর্তী প্রভাব
- বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এই নির্বাচনকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখে। ফাতেমা জিন্নাহর প্রতি ব্যাপক সমর্থন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনাকে উজ্জীবিত করে।
- আইয়ুব খানের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অসন্তোষ: নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জনমনে গভীর অসন্তোষ দেখা দেয়। এটি পাকিস্তানে এক বড় রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয় এবং আইয়ুব খানের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে আস্থা কমে যায়।
- স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ প্রশস্তকরণ: নির্বাচনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরও শক্তিশালী হয় এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি তীব্র হয়। এই নির্বাচন পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি তৈরি করে।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
১. ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও প্রভাব কী ছিল?
২. মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার সুবিধা ও অসুবিধা ব্যাখ্যা করুন।
৩. ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনে অংশগ্রহণ কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
৪. ১৯৬৫ সালের নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানে কীভাবে ভূমিকা রেখেছিল?
৫. ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিজয়ের পরিণতি কী ছিল?
উপসংহার
১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অধিকারহরণের অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই নির্বাচন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনের জন্য শক্তিশালী প্রেরণা যোগায়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের এই অধ্যায় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ হবে।
Related Posts
-
খাদ্যশস্য
No Comments | Oct 15, 2024
-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও প্রভাব
No Comments | Oct 13, 2024
-
মুক্তিবাহিনী
No Comments | Oct 13, 2024
-
মুক্তিযুদ্দের সেক্টর সমূহ
No Comments | Oct 13, 2024