মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও প্রভাব

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল দ্বিমুখী এবং অনেকটা বিতর্কিত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমদিকে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল না। বরং পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল দৃঢ়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কিছু কর্মকর্তা এবং সাধারণ জনগণের একটি অংশ গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও প্রভাব

১. পাকিস্তানের প্রতি সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করত। এই কারণেই, মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি সমর্থন জানায়। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে এবং নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশ আন্দোলনকে আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করে।

২. নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের নীতিমালা:

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের প্রতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন। তারা বাংলাদেশ আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিষয়টি সমর্থন করেননি। কিসিঞ্জার নিক্সন প্রশাসনের সাথে একমত হয়ে মনে করেছিলেন যে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৩. আর্চার ব্লাডের প্রতিবাদ (ব্লাড টেলিগ্রাম):

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের নির্যাতন এবং গণহত্যার নিন্দা করেছিলেন। মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাড, যিনি ঢাকায় মার্কিন কনসুল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে একটি টেলিগ্রামে (“ব্লাড টেলিগ্রাম” নামে পরিচিত) পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিষয়ে প্রতিবাদ জানান। তিনি নিক্সন প্রশাসনকে জানিয়ে দেন যে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং এটি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪. পাকিস্তানপন্থী অবস্থান:

যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ নৌবহরকে ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক অভিযান চালানোর সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নৌবহর প্রেরণ করে। তবে, এই নৌবহর সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এবং শেষ পর্যন্ত এটিকে ব্যবহার করা হয়নি। এই পদক্ষেপ ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল, যা পাকিস্তানপন্থী অবস্থানের পরিচায়ক ছিল।

৫. মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ও জনগণের সমর্থন:

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করে। অনেক মানবাধিকার সংস্থা এবং সাধারণ নাগরিক বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। তাদের প্রচারণার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং জনগণের একাংশ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে।

৬. পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং পরিবর্তন:

যুদ্ধের শেষের দিকে যখন ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধি পায়, তখন মার্কিন সরকার তাদের অবস্থান পর্যালোচনা করতে শুরু করে। তবে, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন পাকিস্তানকে সমর্থন করেই যায়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রভাব

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও তারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এবং গণহত্যার ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনও তীব্র নিন্দা জানায়নি, তবে মার্কিন জনগণের একাংশ এবং ব্লাড টেলিগ্রামের মত পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সহায়ক হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি কৌশলগত ব্যালেন্স তৈরি করে এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ফলাফলে প্রভাব ফেলে।

বিসিএস ও অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট:

  • নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের পাকিস্তানপন্থী নীতি: পাকিস্তানের প্রতি সমর্থনের কারণ এবং এর প্রভাব।
  • আর্চার ব্লাড ও ব্লাড টেলিগ্রাম: মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাডের প্রতিবাদ এবং এর তাৎপর্য।
  • ষষ্ঠ নৌবহরের মোতায়েন: মার্কিন নৌবহর পাঠানোর উদ্দেশ্য এবং এর প্রভাব।
  • মার্কিন জনগণ ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা: জনগণের সমর্থন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাজ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্বিমুখী ছিল। তাই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বুঝতে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক।

4o

Add a Comment