স্বেচ্ছা-খেলাপিদের ছলচাতুরী**

প্রথম আলো, ০৪ জানুয়ারি ২০১৮
এস এম আবু জাকের: ইভিপি এবং আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক, এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড, চট্টগ্রাম।


প্রচলিত বিধিবিধান অনুযায়ী একজন ঋণগ্রাহক খেলাপি হওয়ার পেছনে যে কারণই থাক না কেন, এর গুরুত্ব বিবেচনা করে খেলাপি গ্রাহকদের আলাদা করে বিবেচনায় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাপারটা এমন যে এক কর্মচারী অলসতাবশত অফিস খেলাপ করেছেন আর অন্যজন মায়ের অসুস্থতার কারণে অফিস খেলাপ করেছেন-দুজনই খেলাপি হলেও যদি দুজনই একই ধরনের শাস্তি পান, তাহলে দ্বিতীয়জনের শাস্তিটা মানবিকতার প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। অনুরূপভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির শিকার হয়ে খেলাপি হওয়া ব্যক্তিকে স্বেচ্ছা-খেলাপির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে সব ধরনের খেলাপিকে একই কাতারে এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়াও নৈতিকতার প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ।

এক ব্যবসায়ী ব্যবসা করে অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। পণ্য ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের টাকা দিয়ে জমি কিনলেন। ঋণের মেয়াদ শেষ হলে তিনি সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারলেন না। মনে করেছিলেন ব্যবসার আয় থেকে ওই ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে, কিন্তু ব্যবসা ভালো না হওয়ায় তা পারা গেল না। তিনি ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে ঋণের সুদ মওকুফের জন্য আবেদন করলেন। ম্যানেজার অপারগতা প্রকাশ করলেন। গ্রাহকও ঋণ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করলেন। অথচ তিনি তাঁর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন, কিন্তু তিনি তা করবেন না। কারণ, তিনি স্বেচ্ছা-খেলাপি

অন্য এক ব্যবসায়ী, যিনি আমদানি বাণিজ্যে নিয়োজিত। ব্যাংকে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। হঠাৎ করে একটি বিদেশি শিপিং লাইন দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় তাঁর আমদানি চালানটি ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ইতিমধ্যে ওই আমদানি চালানের ডকুমেন্ট তাঁর ব্যাংকে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় ব্যাংকও ডকুমেন্টের পেমেন্ট যথাসময়ে ছেড়ে দেয়। গ্রাহক জাহাজ আসার জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে খবর পেলেন, ওই শিপিং লাইন দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ায় তাঁর পণ্যবাহী জাহাজটি যাত্রা করার ছাড়পত্র পাচ্ছে না। ওই পণ্য তিনি আর পেলেন না। ব্যবসায় লোকসান দিলেন। ব্যাংকের দায় পরিশোধ করার মতো তাঁর কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ নেই। খেলাপি হয়ে গেলেন তিনি। ব্যাংকের ঋণ শোধ করার মতো তাঁর কোনো উপায় রইল না। তিনি পরিস্থিতির কারণে খেলাপি, স্বেচ্ছা-খেলাপি নন

বাংলাদেশে স্বেচ্ছা-খেলাপির কোনো সংজ্ঞা নেই। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া স্বেচ্ছা-খেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলেছে, নিচের কারণগুলোর মধ্যে যেকোনোটি প্রতীয়মান হলে তাকে স্বেচ্ছা-খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। কারণগুলো হলো-

ক. স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে তা মঞ্জুরিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে দীর্ঘমেয়াদি কাজে ব্যবহার করা।

খ. যে প্রয়োজনে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে, তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অন্য কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করা কিংবা সম্পদ সৃষ্টি করা।

গ. অনুমোদনহীনভাবে ঋণের অর্থ গ্রাহকের অন্য কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা।

ঘ. ঋণদাতা ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ঋণের অর্থ অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালনা করা।

ঙ. ঋণদাতা ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানিতে মালিকানা নেওয়া বা ডেট ইনস্ট্রুমেন্ট সংগ্রহে বিনিয়োগ করা।

চ. প্রদানকৃত ঋণের অর্থের তুলনায় কম অর্থ নিয়োজিত করা এবং বাদবাকি অর্থ হিসাবায়ন না করা।

উপরিউক্ত সংজ্ঞার নিরিখে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, খেলাপি ঋণের সিংহভাগই গেছে স্বেচ্ছা-খেলাপি গ্রাহকের উদরে। আর নগণ্যসংখ্যক খেলাপি গ্রাহক বৈরী পরিস্থিতির কারণে খেলাপি, যাঁদের ঋণ পরিশোধে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অপারগ। কিন্তু খেলাপি গ্রাহকদের জন্য দেশে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বিদ্যমান, তা সব ধরনের খেলাপির জন্য অভিন্ন। অথচ স্বেচ্ছা-খেলাপির অপরাধ ঘৃণ্য প্রকৃতির। সাধারণ খেলাপিকে কলা চুরির সঙ্গে তুলনা করা হলে স্বেচ্ছা-খেলাপিকে ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে তুলনা করা চলে।

একজন ঋণখেলাপি তাঁর নিজের জমি ও ইমারত বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের একটি ঋণসুবিধা গ্রহণ করেন। তাঁর ব্যবসায় ঋণসুবিধার প্রয়োজন না থাকলেও তিনি ঋণটি গ্রহণ করে সেই টাকা অন্য ব্যাংকের পাঁচ বছরে দ্বিগুণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করলেন। এদিকে বছর শেষে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকঋণ পরিশোধের জন্য তাগাদা দিলে তিনি সাফ বলে দিলেন ব্যবসায় লোকসান হয়েছে, তাই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এক বছরের মাথায় ঋণটি খেলাপি হয়ে গেল। ব্যাংক অনেক চেষ্টা-তদবির করে বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির জন্য মামলা করল। এতে গ্রাহক মোটেও বিচলিত হলেন না, বরং ব্যাংকের এই উদ্যোগের জন্যই যেন এত দিন অপেক্ষায় ছিলেন। মামলা হওয়ার পর তিনি উচ্চ আদালত থেকে ‘স্থিতাবস্থা’র রায় নিয়ে আসেন। ব্যাংক স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে লড়ে তা শূন্য ঘোষণা করতে লাগে দুই বছর। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ বছর লেগে যায়। এরপর ঋণগ্রহীতা ভাবেন ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার এটাই উপযুক্ত সময়। তিনি ব্যাংকে গিয়ে প্রস্তাব করলেন সমস্ত সুদ মওকুফ করা হলে আসল টাকা পরিশোধ করতে রাজি আছেন।

এদিকে মামলা চালাতে ক্লান্ত ব্যাংকও শেষ পর্যন্ত আসল টাকাটা উদ্ধারের স্বার্থে গ্রাহকের প্রস্তাব মেনে নেয়। গ্রাহক স্কিম ডিপোজিট ভাঙিয়ে ঋণের আসল টাকা পরিশোধ করলেন এবং ব্যাংক থেকে বন্ধকি সম্পত্তি ছাড় করিয়ে নিলেন। গ্রাহক আসল ঋণের সমপরিমাণ সুদ আয় করে যথেষ্ট লাভবান হয়ে সন্তুষ্ট। এ ধরনের স্বেচ্ছা-খেলাপিরা জাতির শত্রু।

কোনো ঋণখেলাপি যদি ঘোষণা দেন যে ঋণ পরিশোধ করার মতো তাঁর কোনো সামর্থ্য নেই। এরপরও ব্যাংক মামলা করে বছরের পর বছর খেলাপির পেছনে দৌড়াতে থাকে। বন্ধকি সম্পত্তি থাকলেও আদালত যখন নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা নেন, তখন খুব কম ক্ষেত্রেই নিলাম ক্রয়ের জন্য ক্রেতা পাওয়া যায়। নানা ধরনের আইনি জটিলতার কারণে ক্রেতারা এ দেশে নিলাম ক্রয়ে আগ্রহ দেখান না। সে ক্ষেত্রে ঋণ দুই ক্ষেত্রেই অপরিশোধিত থেকে গেল।

ব্যাংক সাধারণত যে ক্ষেত্রে সম্পত্তি বন্ধক ছাড়া ঋণ দেয়, সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের নিট সম্পত্তি বিবেচনা করেই ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু ওই ঋণ যখন খেলাপি হয়ে যায় এবং গ্রাহক বলেন যে ঋণ পরিশোধ করার মতো তাঁর সামর্থ্য নেই, তখন নিট সম্পত্তির বিষয়টি সামনে চলে আসে। ব্যাংকারের দৃষ্টিতে গ্রাহক ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণটি পরিশোধ করছেন না আর গ্রাহকের ঘোষণা হলো তাঁর সামর্থ্য নেই। তাহলে গ্রাহকের সামর্থ্য আছে কি নেই, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। যদি প্রমাণিত হয় যে ঋণ পরিশোধ করার মতো গ্রাহকের সামর্থ্য আছে, তাহলে ল্যাঠা চুকে যায়। তবে এই প্রমাণটা করার দায়িত্বভার কে নেবে?

কোনো বিশেষ কারণে ব্যাংক হয়তো কোনো গ্রাহকের সুদ মওকুফ করে দিয়েছিল কিংবা আসলের একটা অংশ মাফ করে দিয়েছিল। স্বেচ্ছা-খেলাপি ব্যক্তি যত বড় সম্পদশালীই হোন না কেন, ওই বিশেষ ঘটনাকে পুঁজি করে তিনিও এ ধারণা পোষণ করেন যে একপর্যায়ে ব্যাংক তাঁর ঋণের সুদ কিংবা আসলের বড় একটা অংশ মওকুফ করে দেবে। আর তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করেন না।

স্বেচ্ছা-খেলাপি এ দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে দুরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছেন। সংক্রামক ব্যাধির রোগীকে বৃহত্তর স্বার্থে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়। স্বেচ্ছা-খেলাপিদের ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশন নীতিমালাও আলাদাভাবে করার পাশাপাশি অর্থঋণ আদালত আইনে আলাদা শাস্তির ব্যবস্থা রাখা জরুরি।

এ দেশে দেউলিয়াবিষয়ক আইন প্রণীত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে আলাদা দেউলিয়া আদালতও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিকারের হার অত্যন্ত হতাশাজনক। খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার পেছনে এটাও বড় কারণ।

Add a Comment