সুশাসন ও উন্নয়ন :প্রেক্ষিত বাংলাদেশ*

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ এপ্রিল, ২০১৬ ইং
রেজাউল করিম খোকন-ব্যাংকার


বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা পাওয়ার অন্যতম ভিত্তি হবে সুশাসনের উন্নতি। জবাবদিহি ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ ও কারিগরি সহায়তা অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারি কেনাকাটা, নিরীক্ষা ও সংসদীয় ব্যবস্থার তদারকি জোরদার করা এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রশাসন স্বয়ংক্রিয় করাকেই বেশি প্রাধান্য দেবে বিশ্ব ব্যাংক। যে প্রকল্পগুলোতে বিশ্ব ব্যাংক ঋণ ও কারিগরি সহায়তা দেবে সে সব প্রকল্প যেন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে সে ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংক বেশি প্রাধান্য দেবে বলে জানিয়েছে। ‘সুশাসন’ বা গুড গভর্নেস মূলত একটি পশ্চিমা অভিধা। দেশে সুশাসন ও সুশীল সমাজ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক অনেক ধারণাই গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো এবং তাদের পলিসি এজেন্ডা থেকে উদ্ভূত।

দাতা সংস্থাগুলো প্রায়ই সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার শর্ত জুড়ে দেয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। আসলে সুশাসনের কোনো সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সজ্ঞা নেই। সুশাসন মানে ভালোভাবে দেশ পরিচালনা বিষয়টিকে এ ভাবে সরলীকরণ করা যেতে পারে। যেমন- মানবাধিকার ও আইনের শাসন, দেশ পরিচালনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে মানুষের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রক্রিয়া বহুমুখী অংশীদারিত্ব, রাজনীতিতে নানা মতের চর্চা, একটি দক্ষ ও কার্যকর সরকারি খাত, শিক্ষা, তথ্য ও অন্যান্য জ্ঞান আহরণের সুযোগ, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, সমতা ও ন্যায় বিচার, দায়িত্বশীলতা, ঐক্য ও সহনশীলতা উত্সাহিত হয় এমন আচরণ ও মূল্যবোধ ইত্যাদি। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ভূতপূর্ব কমিশন ইউএনসিএইচআরের ২০০০/৬৪ নম্বর প্রস্তাবে সুশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।

এগুলো স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণ ও জনগণের চাহিদার প্রতি সাড়া প্রদান। এ প্রস্তাবে সুশাসনকে টেকসই মানব উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার ভোগ করা এবং টেকসই মানব উন্নয়নের সহায়ক একটি অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে সুশাসনকে স্পষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। এতে আরো উল্লেখ রয়েছে- সুশাসন ও মানবাধিকারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে চারটি ক্ষেত্রে- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো, রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণকে সেবা প্রদান, আইনের শাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ। বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা মূলভিত্তি হবে সুশাসন- তেমন চিন্তা-ভাবনার প্রকাশের মধ্যেই সুশাসনের গুরুত্ব নিহিত রয়েছে। সুশাসনকে কোনোভাবেই এড়িয়ে চলা কিংবা অবজ্ঞা করার অবকাশ নেই।

আজ সবাই গভীরভাবে উপলব্ধি করছেন দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আইনের শাসনের ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের উন্নয়নকে টেকসই করতেও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে হবে। আমরা মনে করি, শতভাগ সুশাসনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না করতে পারলে ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের পক্ষে উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছার লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। সুশাসনের অভাবে দেশ সমৃদ্ধির বদলে বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতে পারে। এ রকম বহু নজির বর্তমান বিশ্বে রয়েছে। বিশেষ করে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক খাতে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং সুশাসনের অভাব গত এক দশকে গোটা অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোতে চরম অব্যবস্থা এবং অবক্ষয়ের সৃষ্টি করেছে। বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে হ্যাকিং-এর মাধ্যমে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা চুরির বা পাচারের অবিশ্বাস্য ঘটনা আমাদের হতাশ করে তুলেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনোভাবে সম্ভব হবে না। সুশাসনের অভাব আমাদের নাগরিক অধিকারকে প্রতিনিয়তই খর্ব করছে এটা বুঝতে হবে এবং উপলদ্ধি করতে হবে সবাইকে। উন্নয়নের সূচকে ইতোমধ্যে আমরা যতটা পথ এগিয়েছি, সুশাসনের অভাব আমাদেরকে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি পিছিয়ে দিতে পারে।

Add a Comment