BCS-Solution

মজুরি নিয়ে কথা বলা যাবে না কেন?***

প্রথম আলো, ০৯ মার্চ ২০১৮
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব


বাংলাদেশে তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে এই শিল্পে মজুরি নির্ধারণ নিয়ে সুশীল সমাজকে আলোচনা-সমালোচনায় না যেতে অনুরোধ করা হয়েছে। এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের মধ্য থেকেও যেন এ নিয়ে কোনো আন্দোলন-বিক্ষোভ না হয়, সে জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে। বিজিএমইএর যুক্তি, এই খাতে নতুনভাবে মজুরি নির্ধারণ করতে সরকার ওয়েজ বোর্ড গঠন করেছে। এতে সংশ্লিষ্ট সব শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। তাই এ নিয়ে মাতামাতি করলে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন হবে।

শ্রমিকদের চাহিদা ও মালিকদের সামর্থ্যের সঙ্গে সমন্বয় বিধান করে ওয়েজ বোর্ড সুপারিশ পেশ করবে। এ সময় শ্রমিকদের কোনো আন্দোলন-বিক্ষোভ কাম্য নয়-এ বিষয়ে ভিন্নমত নেই। তবে তাঁদের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থাগুলোর (ট্রেড ইউনিয়ন) মাধ্যমে চাহিদা ওয়েজ বোর্ডের কাছে তুলে ধরার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। তেমনি নাগরিক সমাজে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলে তা ওয়েজ বোর্ডের কাছে গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুপারিশ তো তারাই করবে। আর চূড়ান্ত অনুমোদনের কর্তৃত্ব সরকারের। জাতীয় বেতন কমিশন তো সমাজের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশ প্রণয়ন করে।

ওয়েজ বোর্ড তেমনটা করবে কি না জানি না। এটি গঠিত হয়েছে গত জানুয়ারিতে। ছয় মাসের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ করার কথা। এই বোর্ডের কাঠামোর শীর্ষে রয়েছেন একজন সিনিয়র জেলা জজ। মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য হিসেবে রয়েছেন যথাক্রমে বিজিএমইএর সভাপতি ও জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের একজন প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকসহ মোট তিনজন স্বতন্ত্র সদস্য রয়েছেন। মালিক-শ্রমিকের দর-কষাকষিতে এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি কীভাবে স্বতন্ত্র সদস্য হন, তা বোধগম্য নয়। আর এতে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব যে একেবারে ক্ষীণ, তা-ও স্পষ্টত দৃশ্যমান।

তৈরি পোশাকশিল্প খাত আমাদের দেশকে অনেক দিয়েছে এবং দিচ্ছে। কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থসামাজিক খাতে এই শিল্পের একক অবদান নজর কাড়ার মতো। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আয় ছিল ২ হাজার ৮১৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮০ দশমিক ৭ শতাংশ আর জিডিপির ১২ দশমিক ০৬ শতাংশ। অবশ্য এই রপ্তানি আয়ের ৭০-৭৫ শতাংশ ব্যয় করতে হয় তৈরি পোশাকশিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাপড়, তুলা, সুতাসহ অনেক কিছু আমদানির জন্য। তবে খাতটি দেশের অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক গতি আনতে সক্ষম হয়েছে।

এটাকে সফল করতে উদ্যোক্তাদের ভূমিকা ও ঝুঁকি নেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসনীয়। ঠিক তেমনি তাঁরাও এতে শ্রমিকদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্বীকার করে থাকেন। এখন এই খাতে প্রায় ৫ হাজার কারখানায় ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করছেন। এতে নারীর সংখ্যাই বেশি। তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতি সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, নারী শ্রমিকদের অনুপাত ক্রমান্বয়ে কমছে। ২০১৫ সালে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৬৪ দশমিক ৩৬ থেকে হ্রাস পেয়ে হালে ৬০ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করে মালিকেরা এগুলো পরিচালনার জন্য নারীর চেয়ে পুরুষদের অধিক নির্ভরশীল মনে করছেন।

মূল কথা হলো ওয়েজ বোর্ডটিতে কার্যত শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব হালকা। এ দেশে ট্রেড ইউনিয়ন স্থিতিশীলভাবে দাঁড়াতে পারেনি, পোশাকশিল্পের মতো এত বড় খাতে এটা প্রায় অস্তিত্বহীন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি ব্যাংকের মতো সংবেদনশীল খাতে অনেকটা কর্তৃত্ববাদী ভূমিকায়। এ অবস্থা ওয়েজ বোর্ডকেই অধিকতর দায়বদ্ধতায় ফেলেছে। মজুরি কাঠামো সুপারিশ করতে তাদের বিবেচনায় নিতে হবে চলমান কাঠামোর সূচনা থেকে মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয়, বাড়িভাড়া, শিল্পের সামর্থ্য এবং অর্থনৈতিক সূচকসমূহ। ২০১৩ সালের মজুরিকাঠামোয় একজন অদক্ষ শ্রমিকের মূল বেতন ছিল ৩ হাজার টাকা। ভাতাসহ সাকল্যে ৫ হাজার ৩০০ টাকা। বছরে বেতন বৃদ্ধি ৫ শতাংশ। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বনিম্ন স্তরে মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা। ভাতাদিসহ সাকল্যে ১৬ হাজার টাকার কাছাকাছি। একজন অদক্ষ শ্রমিককে এই পরিমাণ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তৈরি পোশাকশিল্প খাতের আছে কি না, সেটা বিবেচনার বিষয়।

তৈরি পোশাকশিল্প খাত ২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানি ৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করতে চায়। এতে আরও ৪০ লাখ শ্রমিকের প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে মনে হয়, ওই স্তরে যেতে আরও কিছু সময় নেবে। তবে শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে মজুরিও বাজারের টানেই বেড়ে যাওয়ার কথা। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া দরকার। আরও বিবেচনায় রাখা দরকার, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরি কত দিচ্ছে। এই শিল্পের জন্য কোন কোন দেশ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়। আমাদের দেশ একরকম বিনা শুল্কে এই শিল্প পরিচালনা করার সুযোগ দিচ্ছে। করদাতা জনগণের টাকায় দিচ্ছে রপ্তানির জন্য আর্থিক প্রণোদনা। চীনে শ্রম মজুরি অঞ্চলভেদে বিভিন্ন রকম। গ্রামাঞ্চলে ন্যূনতম মজুরি ১ হাজার ১৬০ ইউয়ান। অন্যদিকে শিল্পসমৃদ্ধ শেনজেন অঞ্চলে ২ হাজার ৩০ ইউয়ান। টাকার অঙ্ক হিসাব করলে গ্রামাঞ্চলের মজুরিই আমাদের বর্তমান মজুরির চেয়ে বেশি। কথা হলো তারা পারলে আমরা পারব না কেন?

এসব বিষয় নিয়ে যত বেশি লেখালেখি ও আলোচনা হবে, তত বেশি সমৃদ্ধ হবে ওয়েজ বোর্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। পৃথিবীব্যাপী মজুরি নিয়ে শ্রমিক-মালিকের স্বার্থের সংঘাত আছে। মালিক কম বেতনের শ্রমিক চান। শ্রমিক চান বেশি বেতন। সেখানে ন্যূনতম বেতন নির্ধারণের ভূমিকায় সরকারকেই থাকতে হয়। এই ব্যবস্থা আছে সব দেশে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো কট্টর পুঁজিবাদী দেশেও ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দেওয়া হয়। আমাদের সরকারও তা-ই করে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের ওপর একটি প্রভাববলয় সক্রিয় থাকে। বিজিএমইএ এ দেশে ব্যাপক চাপ দেওয়ার অবস্থানে রয়েছে।

রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা-পূর্ব ও উত্তরকালের সূচনায় নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের স্বার্থকে বড় করে দেখত। তাদের আন্দোলন-সংগ্রামও ছিল এদের চাহিদাকেন্দ্রিক। কিন্তু যুগের হাওয়া পাল্টে গেছে। শিল্পপতি ব্যবসায়ীরাই এখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। ক্ষমতাসীন দল এটা মেনেও নিয়েছে। আরেকটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সূচনা থেকেই উঠতি ধনিক শ্রেণির লোকদের নিয়ে গঠিত। স্বল্পবিত্ত মানুষের হয়ে কথা বলে এমন রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা বিপরীতমুখী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা হবে যদি দেশে কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়। তখন মূল্যবান হবে এসব শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজনের ভোট। সেই পথে আমরা আবার কবে কীভাবে যাব, তা অনিশ্চিত।

অর্থনীতিবিদেরা আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সম্পর্কেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। অবশ্যই কারখানার প্রকৃত সামর্থ্য বিবেচনায় নিতে হবে। কারখানা লাভজনক না হলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। হবে না নতুন নতুন কর্মসংস্থান। অনেক প্রতিকূলতার মাঝ দিয়ে চলছে এই শিল্প। রানা প্লাজা ধসের পর অনেক নতুন বিনিয়োগ করতে হয়েছে। আর তা নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সেই কারখানাগুলোর চাকা যাঁরা চালু রাখছেন, সেই শ্রমিক শ্রেণিকে ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। নিট মুনাফা কিছুটা কমতে পারে। তবে সেই শ্রমিকেরাই নতুন উদ্যমে এটা পুষিয়ে দেবেন। এই খাতে মজুরি নির্ধারণ নিয়ে যখন কাজ চলছে, তখন বিভিন্ন মহলের পরামর্শ আসতে থাকুক। এ নিয়ে সবাইকে চুপচাপ থাকার পরামর্শ অযৌক্তিক।

Exit mobile version