তিস্তা নদীর পানি ব্যবহার চুক্তি হতে আর কত দূর

বণিকবার্তা, মে ১৬, ২০১৮
ম. ইনামুল হক, প্রকৌশলী ও সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা; চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট


গঙ্গা নদীর উৎস ভারতের উত্তরাখণ্ড প্রদেশের উত্তরকাশী জেলায় হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ ঢাল থেকে বের হয়ে আসা গঙ্গোত্রী হিমবাহ ও গড় সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৭ হাজার ১০ মিটার উঁচুতে। এর কিছু পশ্চিমে একই উচ্চতায় একই জেলার যমুনেত্রী হিমবাহ থেকে যমুনা নদীর উত্পত্তি। এ দুই নদী ভাটিতে এলাহাবাদের কাছে মিলিত হয়। গঙ্গা এলাহাবাদের কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে যমুনা মধ্যভারত থেকে উত্পন্ন চম্বল, বেতওয়া ও কেন নদের প্রবাহ গ্রহণ করে। গঙ্গা পরে হিমালয় থেকে উত্পন্ন গোমতী নদী, এরপর সারদা, করনালী, মহকালী, ভেরী ও রাপ্তি নদীর পানি মিলিতভাবে ঘাঘরা নদীর মাধ্যমে, কালী ও গণ্ডকী নদীর পানি গণ্ডক নদের মাধ্যমে, সন কোশী, অরুণ, বাঘমতী নদীর পানি সপ্তকোশী নদীর মাধ্যমে এবং মেচী ও মহানন্দা নদীর পানি ফুলহার নদের মাধ্যমে গ্রহণ করে। এগুলোর মধ্যে গোমতী ও মহানন্দা ভারত থেকে, অরুণ চীন থেকে ও বাকি নদ-নদী নেপাল থেকে উত্পন্ন। গঙ্গা তার যাত্রাপথে মধ্যভারতের বিন্ধ্য পর্বত থেকে উত্পন্ন শোন নদের প্রবাহ গ্রহণ করে। দিল্লি ও আগ্রা শহর যমুনার তীরে এবং কানপুর, এলাহাবাদ, বারানসী, পাটনা ও ভাগলপুর শহর গঙ্গার তীরে অবস্থিত। গঙ্গা এরপর বাংলার সমতলে প্রবেশ করেছে।

গঙ্গা রাজমহল পাহাড় ভেদ করে বাংলার সমতলে প্রবেশের পরেই বাম দিকে পাগলা নামে এর এক ছোট শাখা বেরিয়েছে, যা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে মহানন্দা নদীতে পড়েছে। কানসাটের কাছে পাগলা নদীর উপরে বিল ভাটিয়া থেকে আসা চাকলা নদীর ওপর একটি স্লুইস গেট নির্মাণ হয়েছে। বিল ভাটিয়ায় একটি বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম আছে। তবে ভারতে শাখাটির উৎসমুখ নদীতীর প্রতিরক্ষা কাজের জন্য এখন বন্ধ। এর একটু ভাটিতেই ফারাক্কার কাছে গঙ্গার ওপর ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হয়েছে। গঙ্গা নদীর প্রবাহ রোধক মোট ১০৯টি গেটসম্পন্ন এ ব্যারেজের মুখে দক্ষিণপ্রান্তে একটি ডাইভারশন রেগুলেটর আছে, যা দিয়ে ৪০ হাজার কিউসেক পানি একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ভাগীরথীতে পাঠানো যায়। গঙ্গা নদী দিয়ে আগে যেখানে ন্যূনতম ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশের দিকে আসত, এখন এ ব্যারেজের ফলে তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এবং ১৯৯৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী ২৭ হাজার কিউসেক পানি বরাদ্দ হয়েছে।
গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হওয়ার সময় থেকে এর পানি ভাগাভাগি নিয়ে এক হতাশ করার মতো ইতিহাস আছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৮ এপ্রিল ১৯৭৫-এর চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি সরিয়ে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয় এবং বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৪৪ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার গ্যারান্টি দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে ভারত ইচ্ছামতো পানি সরিয়ে নিতে থাকে। এর প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী ১৯৭৭ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চ করেন। এরপর ওই বছর ৫ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ন্যূনতম ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি দেয়ার অঙ্গীকার ছিল। পাঁচ বছর মেয়াদের ওই চুক্তি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আর বহাল থাকেনি। এরশাদ আমলে দুবার সমঝোতা হলেও ১৯৮৮ সালের পর ১৯৯৬ পর্যন্ত কোনো কিছুই ছিল না এবং ভারত গঙ্গার প্রায় সব পানিই প্রত্যাহার করে নিয়ে গেছে।

গঙ্গা নদী তার উত্পত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়া পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৫৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। ভারত, চীন, নেপাল ও বাংলাদেশে গঙ্গার অববাহিকা প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ বর্গকািলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্র তার উত্পত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার ৮৪৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। ভারত, চীন, ভুটান ও বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা প্রায় ৫ লাখ ৩২ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের মোট জলসম্পদের উৎস ব্রহ্মপুত্র ৪৯ শতাংশ, গঙ্গা নদী ৩৩, মেঘনা ১২ এবং কর্ণফুলী ও অন্যান্য নদী ৬ শতাংশ। নদীগুলোর মাধ্যমে যে মিঠা পানি আসে, তা আমাদের খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় পূর্ণ করে, সাগরতট অঞ্চলের মিষ্টি পানির পরিবেশ রক্ষা করে এবং মহীসোপানে নানা প্রজাতির মাছের প্রজননে সাহায্য করে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের মাধ্যমে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন টন পলি এসে পড়ে। তবে গাঙ্গেয় বদ্বীপের মাটিতে চাষকৃত জমির ধুয়ে আসা কাদার পরিমাণ বেশি।

গঙ্গার পানি ব্যবহার নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে বটে কিন্তু তিস্তা নদী নিয়ে চুক্তি এখনো হয়নি। তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের প্রধান উপনদীগুলোর একটি। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ তিস্তা নদী থেকে শীতকালে পানি পাচ্ছে না। কথা ছিল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার পানির একটা ভাগাভাগি হবে, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ওই চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। ওই দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে আসেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না আসায় চুক্তি হয়নি। ভারত এখন তিস্তা নদীর তলানি প্রবাহের কোনো ভাগই বাংলাদেশকে দিতে চায় না এবং ২০১২ সাল থেকে দিচ্ছেও না। ভারত সংযোগ খালের মাধ্যমে তিস্তার সমুদয় প্রবাহ মহানন্দা পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যার অনেকটা বিহারে চলে যাচ্ছে। এখন গজলডোবা ব্যারেজের ভাটিতে বালির তলা থেকে বের হওয়া কিছু প্রবাহ বাংলাদেশে আসে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘তিস্তায় তো জল নেই!’ মমতা ব্যানার্জি প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য নদী বিশেষজ্ঞ শ্রী কল্যাণ রুদ্রকে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীকল্যাণ রুদ্র যে রিপোর্ট দিয়েছেন, মমতা তা প্রকাশ হতে দেননি।

তিস্তা নদীতে ঐতিহাসিকভাবে বর্ষাকালে গড়ে ২ লাখ ৮০ হাজার কিউসেক এবং শীতে গড়ে ৬ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। উল্লেখ্য, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে ১৯৫২ সাল থেকে আলোচনা শুরু হলেও ষাটের দশকে গঙ্গার পানি বণ্টনের বিষয়টি চলে আসায় তা পিছিয়ে যায়। ১৯৭৭ সালের গঙ্গা নদীর পানি চুক্তির পর বিষয়টি আবার উঠে আসে। কিন্তু ১৯৮২ সালে গঙ্গা নদীর পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সবকিছুই হারিয়ে যায়। চুক্তির অভাবে আশির দশকের শেষে ও নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ভারত গঙ্গা নদীতে পানি ছাড়াই প্রায় বন্ধ করে দেয়। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানি বণ্টনের দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর তিস্তাসহ ধরলা, দুধকুমার, মনু, খোয়াই, গোমতী ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ও উঠে আসে। এর মধ্যে বাংলাদেশ তিস্তা নদীর ওপর একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু করেছে। বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় ৬ দশমিক ৩২ লাখ হেক্টর এলাকায় সেচ প্রদানের জন্য এর ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহারের ক্ষমতা আছে। তবে ভারতও তিস্তার ওপর গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে সংযোগ খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে উত্তরবঙ্গে ছয়টি জেলায় প্রায় ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর এলাকায় সেচকার্য হাতে নিয়েছে। এছাড়া ভারত সিকিমে তিস্তার উপনদীগুলোয় ড্যাম বসিয়ে অনেকগুলো জলাধার করেছে, যার কারণে তিস্তার তলানি প্রবাহ আটকা পড়ছে।

তিস্তার পানি না পাওয়ায় উত্তরবঙ্গের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক গতিতে নেমে যাচ্ছে। গভীর নলকূপগুলোয় সেচের পানি তুলতে অনেক বেশি শক্তি ব্যয় হচ্ছে, অনেক নলকূপে পানি উঠছে না। তিস্তা সেচ প্রকল্প পানি পাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের বিস্তৃত এলাকায় সেচ নেই। এসবের ক্ষতি এবং জনজীবন ও প্রকৃতিতে ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করলে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো হবে। ভারত সবসময় বলছে, সে এমন কাজ করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। অথচ স্যাটেলাইট চিত্রে স্পষ্ট দেখা যায়, ভারত তিস্তার পানি সরিয়ে নিয়ে খাল দিয়ে ডাহুক নদীতে ফেলে দিচ্ছে। যেখান থেকে ওই পানি বিহারে চলে যাচ্ছে। আমরা তিস্তার পানি ব্যবহার চুক্তি নিয়ে উভয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি গজলডোবা মার্চ করার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরকালে বলেন, তিস্তার পানি ভাগাভাগির চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত করা হয়ে গেছে (১৬.০১.১৮, ঢাকা ট্রিবিউিন)। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ওই মার্চ পরিকল্পনা স্থগিত করি। কিন্তু এখন মে মাস চলছে, যৌথ নদী কমিশনের বা তিস্তা নিয়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৈঠকের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে উভয় দেশের জনগণের স্বার্থে তিস্তার পানি ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহারের চুক্তি করার দাবি জানাচ্ছি।

Add a Comment