ছুটছে তারা দিগ্‌বিদিক!*

প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি ২০১৮
মুনির হাসান, সাধারণ সম্পাদক, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।


ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।’
রাজা শুধাইলেন, ‘ও কি আর লাফায়।’
ভাগিনা বলিল, ‘আরে রাম!’
‘আর কি ওড়ে।’
‘না।’
‘আর কি গান গায়।’
‘না।’
‘দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়।’
‘না।’
রাজা বলিলেন, ‘একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।’
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করিতে লাগিল।
[তোতা কাহিনী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ]

ডাচ্ বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসবের সময় আমার একটি কাজ হয়, দেশের নানান প্রান্তে ছুটে যাওয়া। এটা আমার জন্য খুবই আনন্দদায়ক একটি কাজ। কারণ, তাতে সারা দেশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, তাদের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পাই। সেই সুযোগে এবারের শীতলতম দিনে আমি ছিলাম বরিশালে। গণিত উৎসবের আগের দিন আমরা গিয়েছি একটি ছেলেদের এবং একটি মেয়েদের স্কুলে। মেয়েদের স্কুলটিতে দুই শিফটে সহস্রাধিক মেয়ে পড়ে। সকালের শিফটের ছুটি শেষে আর দুপুরের শিফটের ক্লাসের শুরুতে আমরা তাদের কম্পিউটার ল্যাবে আয়োজন করি প্রোগ্রামিং শেখার আয়োজন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে এখন স্কুল পর্যায়ে কোডিং (প্রোগ্রাম লেখার সংকেত) শেখানো শুরু হয়েছে। এ জন্য নয় যে সবাই প্রোগ্রামার হবে। এর পেছনের কারণ হলো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যাকে ভেঙে একাধিক ছোট ছোট টুকরায় সমাধান করার দক্ষতা অর্জিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত তাকে একজন কুশলী সমস্যা সমাধানকারী হিসেবে গড়ে তোলে। দেশে স্কুল-কলেজে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের আয়োজনের অংশ হিসেবেই আমরা সেখানে ছিলাম। দুপুরের শিফটের সেশনটি শুরু হওয়ার একটু পরেই একটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নোভা আহমেদের শুশ্রূষায় সে সুস্থ হয়ে ওঠার পর আমরা তার গল্পটি জানতে পারি।

মেয়েটির ক্লাস শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টায় কিন্তু ও বাসা থেকে বের হয়েছে সকাল ৮ টারও আগে। তারপর তিন জায়গায় তিন শিক্ষকের বাসায়/কোচিংয়ে হাজির থেকেছে। তারপর সেখান থেকে হাজির হয়েছে স্কুলে। প্রতিদিনের এই রুটিন মানাটা যে সত্যিই কঠিন, সেটি প্রমাণ করে তার শরীর বিদ্রোহ করেছে আমাদের সামনে! প্রধান শিক্ষক জানালেন, ছাত্রীদের অনেকেই স্কুল শেষে বাসায় ফেরে না, ছুটতে থাকে এক কোচিং থেকে অন্য কোচিংয়ে!

এই গল্প কেবল বরিশালের ওই মেয়েটির নয়। গল্প বাংলাদেশের। তথাকথিত জিপিএ ফাইভের পেছনে এভাবে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কেবল ছুটতে শেখাচ্ছি। তারাও ছুটছে দিগ্‌বিদিক। এতে তার শিক্ষাটা পূর্ণ হচ্ছে কি না, সে ভাবনা কিন্তু কারোরই নেই। কারণ, অধিকাংশ অভিভাবকই ভাবছেন এই কাজ না করলে তাঁর সন্তান জিপিএ-৫ পাবে না, তার জীবন হবে ব্যর্থ! মেয়েটির এই অবস্থা দেখে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তোতা কাহিনীর কথা মনে হয়েছে।

আশ্চর্য হলেও সত্য যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে গেছে সম্পূর্ণ পরীক্ষানির্ভর। এই মহাজগতে কেবল বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়, যা প্রকারান্তরে শিক্ষার্থীকে সার্বিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে না। ছোটবেলা থেকে একজন শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ে পণ্ডিত বানানোর এ চেষ্টা অচিরেই বুমেরাং হবে আমাদের জন্য।

সন্তানদের জিপিএ-৫-এর ইঁদুরদৌড়ে ঠেলে দেওয়া অভিভাবকদের প্রসঙ্গে আমার মনে পড়েছে বছর কয়েক আগে সিঙ্গাপুরের এক হাইস্কুল অধ্যক্ষের কথা। পরীক্ষার আগে আগে অভিভাবকদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে অধ্যক্ষ বলছেন, ‘প্রিয় অভিভাবক, আপনার সন্তানের পরীক্ষা অচিরেই শুরু হবে। আমি জানি, আপনার সন্তানের ভালো ফলের জন্য আপনি অনেক চিন্তিত। কিন্তু মনে রাখবেন, যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেবে, তাদের মধ্যে একজন শিল্পী আছে, যার গণিত বোঝার অত দরকার নেই। আছে একজন উদ্যোক্তা, যার কিনা ইতিহাস বা ইংরেজি সাহিত্যে কিছু আসে-যায় না। আছে একজন সংগীতজ্ঞ, যার রসায়নের নম্বর ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। আছে ক্রীড়াবিদ, যার শারীরিক ফিটনেস কিন্তু ফিজিকসের (পদার্থবিজ্ঞান) চেয়ে বেশি দরকার!

আপনার সন্তান যদি ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর পায়, তাহলে সেটা বিরাট ব্যাপার। কিন্তু তা যদি সে না পায়, তাহলে দয়া করে তার আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করবেন না। তাদের বলুন, ঠিক আছে। এ কেবল একটি পরীক্ষামাত্র। জীবনে এর চেয়ে বড় অনেক কিছু করতে হবে। তারা যেমন নম্বরই পাক না কেন, আপনি তাকে বলুন আপনি তাকে ভালোবাসেন এবং আপনি তার বিচার করবেন না।

অনুগ্রহ করে, এই কাজটুকু করুন এবং যখন তা করবেন, তখন আপনার সন্তানের বিশ্বজয় আপনি দেখতে পাবেন। একটি পরীক্ষা বা একটু কম নম্বর প্রাপ্তি তাদের স্বপ্ন ও মেধাকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। এবং দয়া করে মনে রাখবেন, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরাই পৃথিবীর একমাত্র সুখী লোক নয়। ধন্যবাদসহ।’

যে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের শৈশব আর কৈশোরকে এভাবে নষ্ট করছেন, তাঁদের আমি সিলেট এমসি কলেজের শিক্ষার্থী আসিফ-ই-এলাহী ও সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের সাজিদ আকতারের কথা মনে করিয়ে দেব। এই দুজন শিক্ষার্থীর কেউ কিন্তু পরিবার-পরিজন ফেলে ঢাকার কোনো বিখ্যাত কলেজে পড়তে আসেনি। এমনকি এইচএসসি পরীক্ষায়ও তারা কেউ জিপিএ-৫ পায়নি। ছোটবেলা থেকে তাদের মা-বাবা তাদের গণিতের প্রতি ভালোবাসাকে এগিয়ে নিতে দিয়েছেন। ওরা দুজনই নিয়মিতভাবে আমাদের গণিত উৎসবে যোগ দিয়েছে, স্কুলের পড়া ফেলে জাতীয় গণিত ক্যাম্পে অংশ নিয়েছে। দুজনই আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড থেকে দেশের জন্য রুপা আর ব্রোঞ্জ পদক জয় করে এনেছে। আর এখন, দুজনই বিশ্বের অন্যতম সেরা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে স্নাতক পড়ছে!

প্রিয় অভিভাবক, আসিফ আর সাজিদের মতো আরও অনেককে আপনি আপনার আশপাশে দেখতে পাবেন। জিপিএ-৫-এর জন্য তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগ্‌বিদিক ছুটছে না। তাদের লক্ষ করুন এবং ভালো থাকুন।

আপনার সন্তানের শৈশব ও কৈশোরকে আনন্দময় ও বর্ণিল করে তুলুন। তাকে তার ভালো লাগার বিষয়ে দক্ষ হতে সাহায্য করুন। তাকে তার জীবনকে আনন্দময় ও বর্ণিল করতে সাহায্য করুন। আপনার ভুল স্বপ্নে তাদের তাড়িয়ে বেড়াবেন না।

ওদের জন্য আশ্চর্যময় জগৎ অপেক্ষা করছে। ওরা সেটা খুঁজে নিক। আপনাদের মঙ্গল হোক।

Add a Comment