এরদোয়ানের উত্থানের মূলে পশ্চিমাদের ভুল

প্রথম আলো, ২৭ জুন ২০১৮
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি।


তুরস্ক নতুন এক যুগে প্রবেশ করল। গত এক হাজার বছরের ইতিহাসে তুরস্কের রাজনীতিতে বড় ধরনের বাঁকবদলের ঘটনা আছে তিনটি। প্রথমত, ১২৯৯ সালে অটোমান বা উসমানিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা তুরস্ককে ইতিহাসে নতুন এক জায়গা নির্ধারণ করে দেয়। ইতিহাস বলে, বিভিন্ন সময় অটোমানদের সঙ্গে ইউরোপের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিলই। অটোমানদের পতনের পর ১৯২৩ সালে ইউরোপের মিত্র কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে নতুন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে তুরস্ক। ঠিক তার প্রায় ১০০ বছর পরেই তুরস্ক আবার এক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে। তুরস্কের নতুন নায়ক রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। পরিষ্কার ব্যবধানে প্রধান প্রতিপক্ষ মুহাররেম ইনজিকে হারিয়ে দিয়েছেন ২৪ জুনের নির্বাচনে। এরদোয়ানের সঙ্গে ইউরোপের সরাসরি কোনো সংঘর্ষ না থাকলেও অটোমান-পরবর্তী শাসকদের মতো সম্পর্ক ততটা উষ্ণও নয়।

তুরস্কে অনেকের কাছে প্রিয় হলেও পশ্চিমা সমাজে এরদোয়ানকে নিয়ে প্রশ্ন আছে। পশ্চিমা শক্তি বরাবরই অভিযোগ করেছে, এরদোয়ান গণতন্ত্রকে সীমিত করেছেন। সামরিক অভ্যুত্থান দমনের নামে হাজারো বিরোধী নেতা-কর্মীকে জেলে ভরেছেন। এরদোয়ানের সমালোচনা করলেই চাকরিচ্যুতি ও জেল নিশ্চিত। অথবা দেশত্যাগ। ব্যক্তিগতভাবে একজন অধ্যাপককে চিনি। ওই অধ্যাপক এরদোয়ানের সমালোচনা করে পত্রিকায় কলাম লেখার কারণে এখনো জেল খাটছেন। নতুন সংবিধান বাস্তবায়নের করলে এরদোয়ানই হবেন ভবিষ্যৎ তুরস্কের সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। নতুন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। পার্লামেন্টের ক্ষমতা সংকুচিত হবে।

এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছেন। কিন্তু এরদোয়ান কেন কঠোর হাতে বিরোধীদের দমন করছেন? এরদোয়ান কি অতীতের প্রতিশোধ নিচ্ছেন? এরদোয়ান ও তাঁর দলকেও একাধিকবার জেল ও দমনের শিকার হতে হয়েছে। এরদোয়ানের সাবেক দল ইসলামিক স্যালভেশন পার্টি নির্বাচনে জয়ী হয়েও প্রথমবার ক্ষমতায় যেতে পারেনি তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতা খর্ব হবে এই অভিযোগে। পরেরবার জিতলেও ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়েছে। ক্রমাগত দমনের মুখে পরিবর্তিত নাম নিয়ে নতুন দল করতে বাধ্য হয়েছেন এরদোয়ান। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অধিকার হরণের যে অভিযোগগুলো করা হয়, ওই সময়কার তুরস্কের শাসকদের বিরুদ্ধে কিন্তু একই অভিযোগ উপস্থাপন করেনি পশ্চিমারা। এরদোয়ান বা তাঁর রাজনৈতিক গুরু নাজিমুদ্দিন এরবাকান ইসলামপন্থী ছিলেন বলে পশ্চিমাদের সমস্যা ছিল। এমনটা মনে হতে পারে। প্রকৃত কারণ এটা নয়। তুরস্কের শাসকেরা ইউরোপের স্বার্থ রক্ষা করছেন কি না, সেটিই গুরুত্ব। এ ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী বা ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া কোনো সমস্যা না। এশিয়া মাইনরে অবস্থানের কারণে বরাবরই তুরস্ক ইউরোপের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৌশলগত কারণেই ইউরোপের চাওয়া, তুরস্কে তাদের মিত্ররা ক্ষমতায় থাকুক। এই এরদোয়ানই যদি ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের স্বার্থ নিশ্চিত করেন, তবে তিনি হবেন তুরস্কের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক নেতা।

কার্যত, এরদোয়ানের দলকে শুরু থেকেই বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার করা। এতে ভোটারদের খুশি রাখার বিষয় আছে। সিরিয়া যুদ্ধের কারণে বিশালসংখ্যক উদ্বাস্তু বহন করতে হচ্ছে তুরস্ককে। কুর্দি সমস্যাও তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ক্ষমতা সংহত করতে বিদেশি ষড়যন্ত্রকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে এরদোয়ানকে। ফেতুল্লা গুলেনের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকবারই বিভিন্ন ইস্যুতে তুরস্কের বিরোধী দলকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে পশ্চিমারা। এরদোয়ান পশ্চিমাদের এই ভ্রান্ত নীতিরই সুবিধা নিচ্ছেন। সামরিক অভ্যুত্থানচেষ্টার পর হাজার হাজার অভ্যুত্থান-সমর্থককে জেলে ঢোকানো হয়েছে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অনেকেই দেশছাড়া হয়েছেন।

অভ্যন্তরীণ এসব বিষয় ছাড়াও তুরস্ক বা এরদোয়ানকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যেমন সিরিয়া যুদ্ধ। সিরিয়ার যুদ্ধকে ঘিরে এরদোয়ান এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, যা তিনি কৌশলে কুর্দিদের দমনে ব্যবহার করছেন। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সঙ্গে তুরস্কের বাহিনী সরাসরি কুর্দি অঞ্চলে হামলা করেছে।

একসময়ের তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার এরদোয়ান বা তাঁর দলের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, এরদোয়ান সেই একই আচরণ করছেন ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে। রাজনীতির নাটকের চরিত্র বদল হয়েছে কেবল। কিন্তু আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। মজার বিষয় হচ্ছে, উভয় ক্ষেত্রেই নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আছে বা ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, এরদোয়ান এখন নতুন সুলতান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ধীরে ধীরে সব ক্ষমতাই নিজের হাতে নিয়ে নিচ্ছেন। অটোমান ইতিহাসনির্ভর ‘সুলতান সুলেমান’ বা ‘কোসেম সুলতান’ টিভি সিরিয়ালে দেখেছি, কোনো কিছুর ব্যত্যয় হলেই কথায় কথায় গর্দান চলে যেত। এখন হয়তো কথায় কথায় গর্দান যায় না। তবে কথায় কথায় জেলে ঢোকানো হয়। ইরানেরও একই অবস্থা। বিরোধী মতকে কোনোভাবেই বিন্দুমাত্র জায়গা দেওয়া হয় না। চীনের অবস্থাও ভিন্নতর কিছু না। কিন্তু পশ্চিমারাও আসলেই বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র চায়, নাকি তাদের মিত্রদের ক্ষমতায় বসাতে চায়, এটাও ভেবে দেখার বিষয়। উত্তর কোরিয়া হয়তো এখন কিছুটা ছাড় পেতে পারে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চাপ থেকে। বিশেষ করে ট্রাম্প-কিমের বৈঠকের পর।

বস্তুত, সারা বিশ্বেই যুদ্ধ পরিস্থিতি বজায় রেখে বা অভ্যন্তরীণ বিরোধী শক্তি উসকে দিয়ে কোনো দেশেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। শুধু তুরস্ক কেন, ইরান, চীন বা উত্তর কোরিয়া, বিভিন্ন দেশেই পশ্চিমারা একই কায়দায় তথাকথিত গণতান্ত্রিক মিত্রদের ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছেন। তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সামরিক বাহিনীকে উসকে দিয়েছে ক্ষমতা দখলের জন্য। তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমাদের এই উচ্চকিত হওয়া এক বিশাল ভুল ও ভ্রান্তনীতি। এতে করে কোথাও পশ্চিমাদের প্রত্যাশিত শক্তি ক্ষমতায় আসবে না বা চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায়ও থাকবে না। গণতন্ত্রের সঠিক বিকাশও হবে না। গণতন্ত্র বিকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তি নিশ্চিত করা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব ওই দেশে নাগরিকদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া।

নতুবা পশ্চিমাদের এই ভ্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাঁরা টিকে যান, তাঁরা ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থেই আয়াতুল্লা আলী খামেনি, এরদোয়ান, সি চিন পিং বা কিম জং-উনের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসকে পরিণত হন। জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তাকে এসব শাসক ক্ষমতায় টিকে থাকার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। আর মিসরের মোহাম্মদ মুরসির মতো যাঁরা ঝড়ে উড়ে যান, তাঁদের শূন্যতা পূরণ করে জেনারেল আবদেল সিসির মতো সামরিক স্বৈরাচারেরা। বস্তুত দুটির কোনোটিই কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

Add a Comment