আর্থিক খাতে প্রতিষ্ঠিত হোক শুদ্ধাচার*****

আমাদের সময়, ২৬ মে ২০১৮,
রেজাউল করিম খোকন : ব্যাংকার ও কলাম লেখক


‘শুদ্ধাচার’ শব্দের সৃষ্টি ‘শুদ্ধ’ ও ‘আচার’ শব্দের সমন্বয়ে। শুদ্ধ বলতে আমরা সহজ ভাষায় বুঝি সাধু, পবিত্র, খাঁটি, পরিষ্কার, শোধিত, নির্ভুল, নির্দোষ, নিষ্কলুষ ইত্যাদি। একজন মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য যখন সমাজ এই শব্দগুলোর ব্যবহার ও প্রয়োগ করে তখনই মানুষ শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গণ্য হন। এ জন্য সত্য, সুন্দর ও কল্যাণকর, নৈতিক আদর্শকে চরিত্রে ধারণ ও বাস্তবে রূপায়ণ প্রয়োজন। ব্যক্তি ও পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জীবনধারণের জন্য ভালো আচরণ, ভালো রীতিনীতি, ভালো অভ্যাস রপ্ত ও পরিপালন আবশ্যক।

রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য ও দায়িত্ব হলো নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সমতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই রাষ্ট্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে কৌশল হলো সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা এবং দেশে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা।

শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর মধ্যে একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্রনিষ্ঠা। ব্যক্তির সমষ্টিতেই প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয় এবং তাদের সম্মিলিত লক্ষ্যই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রতিফলিত হয়। একজন মানুষের নৈতিকতা শিক্ষা শুরু হয় পরিবারে এবং শুদ্ধাচার অনুসরণের ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তার পরের ধাপে আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নৈতিক জীবন গড়ার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা অপরিসীম। তৃতীয় ধাপে আছে তার কর্মস্থল। শুদ্ধাচার নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক চর্চার ওপর।

জাতিসংঘ দুর্নীতি নির্মূলের জন্য ফৌজদারি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়াও দুর্নীতির ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১’-এ দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যকে একটি আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ আন্দোলনে দেশের সবাইকে অংশীদার হতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে ১৮ অক্টোবর ২০১২ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও সমাজে কার্যকরভাবে ন্যায় ও সততা প্রতিষ্ঠা এবং সফলতার সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা, সরকারের একটি মূলনীতি।

এই কঠিন কাজটিকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন

নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।

১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,

সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কিনা সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সবাইকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।

আমাদের সব উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশের আর্থিক খাত। এখানে শৃঙ্খলা, সুশাসন এবং সর্বোপরি শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের আশা করা যায় না। আর্থিক খাতে শুদ্ধাচারের চর্চা না থাকলে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণ বাসা বাঁধে সেখানে। তখন সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া চরম হুমকির মধ্যে পড়ে যায়।

ব্যাংকিং ব্যবস্থা যে একটি মাত্র বিষয়ের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছিল সেটি হচ্ছে আস্থা বা বিশ্বাস। অর্থাৎ আদিযুগে মানুষ নগদ অর্থকড়ি কিংবা সোনাদানা ঘরে জমিয়ে বা লুকিয়ে রাখার চেয়ে গির্জা বা মন্দিরের সিন্দুকে রাখাকে অধিকতর নিরাপদ মনে করত। কিন্তু আয় বা প্রতিদান ছাড়া এ রকম অলাভজনকভাবে সম্পদ জমিয়ে না রেখে তার বিপরীতে বিশ্বাসের সঙ্গে লাভ বা সুদ আয় শ্রেয়তর বিবেচিত হয়েছিল বলেই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের জন্ম। ব্যাংকিং সেবার ক্রমজটিলতর বিবর্তন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংঘটিত বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সংকট ও কেলেঙ্কারি উদঘাটনের পর ব্যাংকিং সেবা ও পেশায় নৈতিকতার প্রশ্নটি জোরালোভাবে সামনে উঠে এসেছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আর্থিক খাতে শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমুখী আলোচনা হচ্ছে।

রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানেই শুদ্ধাচার অনুশীলন অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। এটিকে এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ নেই, বিশেষ করে আর্থিক সেক্টরে শুদ্ধাচার অনুশীলন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর্থিক সেক্টর একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ সেক্টর। এখানে আর্থিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সব বিষয় আবর্তিত হয় বিধায় এখানে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, অসাধুতা, অনৈতিকতার চর্চা যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ প্রয়োজন।

গত এক দশকে বাংলাদেশে আর্থিক খাতে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, কেলেঙ্কারি, অর্থ লোপাটের চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো সবাইকে হতবাক করেছে। ব্যাংক খাতে সংঘটিত এসব অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ লোপাটের ঘটনাগুলো এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করেছে ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিতদের মধ্যে। সবাই আজকাল নিজের গা বাঁচাতেই যেন বেশি ব্যস্ত। ব্যাংক থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ নিয়ে বড় বড় ঋণ গ্রহীতারা তা ফেরত দিতে চায় না, ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রায় ক্ষেত্রে বড় বড় ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খান, বাধার সম্মুখীন হন। এসব কারণে এখন ব্যাংক খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বিরাজ করছে স্থবিরতা এবং অনাগ্রহ। আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে যে ব্যাংকিং ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটেছে পৃথিবীব্যাপী তা শুদ্ধাচার এবং নৈতিকতার অভাবে অনেকটাই হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে।

ব্যাংকে প্রতারণা, ঋণ জালিয়াতির ঘটনা, অনিয়ম, দুর্নীতি বাড়লেও ব্যাংক ব্যবসা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েও যাচ্ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে অনেক গতি এসেছে, ব্যাংকের বিভিন্ন আর্থিক সেবায় অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু অর্জিত সাফল্য এবং এগিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অনেক সময় ম্লান হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনায়। ব্যাংক অন্যের আমানত নিয়ে ব্যবসা করে যে কারণে অন্যান্য ব্যবসা প্রয়াসের চেয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে মানুষ অধিকতর নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে। ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে তথা ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধতা থাকবে, স্বচ্ছতা থাকবে এটা যে কোনো গ্রাহক মাত্রই প্রত্যাশা করেন। ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে নৈতিকতার কোনো বিরোধ নেই। বরং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধাচার আবশ্যিক ব্যাপার হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। যদি ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা, অনিয়ম গ্রাস করে, তাহলে সেখানে শুদ্ধতা আশা করা যায় না। মূলত নৈতিকতা বিবর্জিত কাজের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং ব্যাংকারদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমারেখা নির্ধারণ করা উচিত। প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে কেবল উচ্চবিত্ত মুষ্টিমেয় কিছু গ্রাহকের মধ্যে ঋণ সুবিধা সীমিত রাখা সহায়ক জামানতবিহীন সাধারণ মানুষ এবং দরিদ্রদের জন্য ঋণ গ্রহণের সুযোগ না রাখা, মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকি গ্রহণ করে ব্যাংককে বিপদগ্রস্ত করা কিংবা দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোনো উদ্যোগে ঋণ সুবিধা দেওয়া- এসবকেই ব্যাংকিং খাতের অনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত অনৈতিক কর্ম এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নিজেরাই অনৈতিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া- এসবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা উচিত।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য ও দায়িত্ব হলো সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সমতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই রাষ্ট্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে কৌশল হলো সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা এবং দেশের সর্বস্তরে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা।

শুদ্ধাচার নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতার ওপর। ব্যাংক জনগণ, জনগণের অর্থ বা অর্থের সমমূল্য পণ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মকা- চালায়, ব্যবসা করে। ‘মানুষ সব সময়ই উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ এবং ‘অর্থ হলো স্পর্শকাতর সম্পদ।’ কাজেই মানসম্মত গ্রাহকসেবা ও বিশ্বাসযোগ্যতা, দুটোই ব্যাংকের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ দুটি বিষয় প্রধানত নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতার চর্চার ওপর। গ্রাহকসেবার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা, পরিপালন, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা প্রভৃতি মৌলিক আদর্শ ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা বা চর্চা নিশ্চিত করা হলে ব্যাংক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে তেমন কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবে না। তাই ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধাচার চর্চা ও প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে আন্তরিক এবং নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে।

দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহুবিধ আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিকে কেবল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। আশার কথা, দেশে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আমাদের সবার প্রত্যাশা, ব্যাংক ব্যবস্থায় দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূর হয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক শুদ্ধাচার, নিশ্চিত হোক সুশাসন।

Add a Comment