আমাদের মানব কীভাবে সম্পদ হবে***

প্রথম আলো, ১২ জুলাই ২০১৮
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ


আমরা যখন স্কুল-কলেজে পড়ি, মানবসম্পদ কথাটা তখনো চালু হয়নি। আমাদের শিক্ষক আর গুরুজনেরা ‘মানুষ’ কথাটা জোর দিয়ে বলতেন: লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে হবে, ভালো মানুষ হতে হবে, আলোকপ্রাপ্ত মানুষ হতে হবে—আমাদের তাঁরা এসব উপদেশ দিতেন। যারা এসব করতে ব্যর্থ হবে, তারা যে সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, তাঁদের উপদেশের উল্টো পিঠে এ রকম ইঙ্গিতও থাকত।

মানবসম্পদ কথাটা সম্ভবত করপোরেট দুনিয়া অথবা সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষা থেকে এসেছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বলে একটা বিভাগ থাকে, যাদের কাজ চাকরিবাকরির নানা বিষয় নিয়ে। নিয়োগ-পদায়ন-প্রশিক্ষণ থেকে নিয়ে শ্রম আইনের প্রয়োগ ও মান্যতা, প্রশাসনের নানা খুঁটিনাটি এ বিভাগ দেখে। তবে ব্যাপক অর্থে মানবসম্পদ কথাটার ভেতর একটি আদর্শিক ভাব আছে। যে অর্থে পশ্চিমের রেনেসাঁস থেকে নিয়ে আমাদের উনিশ শতকের নবজাগরণ মানবকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে—মানব জাগলে বিশ্ব জাগবে; যুক্তি-জ্ঞান-প্রজ্ঞা দিয়ে মানব পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান করবে, নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলবে, এ রকম বিশ্বাস মানবের ওপর করেছে—সেই একই ভাব আছে মানবসম্পদ কথাটাতে।

তবে করপোরেট যুগের ব্যবস্থাপনার চিন্তাটাও এ ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপনার মতো মানবসম্পদেরও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, এটি এখন ভাবা হচ্ছে। অর্থাৎ মানব যাতে আপদ না হয়ে সম্পদ হয়, সেদিকে লক্ষ রাখাটা সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে গেছে।

মানবসম্পদকে প্রকৃত সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য মানবের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, জ্ঞানগত এবং পেশাগত দক্ষতা, কর্মসংস্থান এ রকম নানা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উন্নতির প্রয়োজন। এসবের অভাব দেখা দিলে মানবসম্পদ আপদে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশের সমাজের দিকে তাকালে সম্পদ সৃষ্টির বিষয়টি কি আমাদের চোখে পড়ে? নাকি নানা আপদের সন্ধান পাই? গত কয়েক দশকে মাদকের প্রসার যে হারে বেড়েছে, তাতে বিশালসংখ্যক তরুণ তো ইতিমধ্যেই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের কেন্দ্রে থাকে তরুণেরা—তারাই শক্তি, তারাই আশা-ভরসা, তারাই ভবিষ্যৎ।

কিন্তু তরুণেরাই যদি মাদকের আক্রমণে জীবনশক্তি খুইয়ে ধুঁকতে থাকে, তাহলে তাদের নিয়ে আমাদের আশাবাদ কি জেগে থাকে? মাদকের মতো সহিংসতা ও সন্ত্রাস—যা আসে রাজনীতি, বাজার ও নানা উগ্রবাদী বিশ্বাসের রাস্তা ধরে—আমাদের যুবসমাজকে সম্পদ হতে দিচ্ছে না। সহিংসতা এখন একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সামান্য কারণে মানুষ সহিংস আচরণ করছে। যুক্তি, তর্ক, আলোচনা যেখানে অনেক দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি করতে পারে, সেখানে খাটানো হচ্ছে গায়ের বা অস্ত্রের জোর। আমাদের রাজনীতিতে যুক্তি-তর্ক নেই, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও নেই। বরং আছে অসহিষ্ণুতা, অন্যকে জায়গা না দেওয়ার মানসিকতা, জোর খাটিয়ে নিজের অভিমত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা।

উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথাটা যখন তোলা হলো, শিক্ষা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। আমাদের দেশে এখন প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তার উদ্দেশ্য আলোকপ্রাপ্ত মানুষ তৈরি করা নয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে চাকরির
বাজারের জন্য কর্মী তৈরি করা।
এ জন্য জোরটা দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা পাস করে একটা সনদ নিয়ে চাকরির বাজারের ঢোকার ওপর। এ জন্য যে পদ্ধতিতে এখন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তাতে পাঠ মুখস্থ করাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে; শিক্ষার্থীদের নিজের চিন্তাভাবনা, কল্পনা, উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো নয়। মুখস্থ করে আর যা-ই হোক, জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায় না, বড়জোর পাঠ্যবইয়ে যা দেওয়া যাকে, তা স্মৃতিতে ধরে রাখা যায়—তা–ও ওই পরীক্ষা পাস পর্যন্ত।

ফলে আমাদের শিক্ষার্থীদের ভাষাদক্ষতার অভাব রয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞান ও গণিতে দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। তারা যুক্তি-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কাজে লাগিয়ে নতুন কোনো চিন্তা তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি যোগাযোগের দক্ষতাটাও তারা অর্জন করতে পারছে না। আমি দেখেছি, কোনো তত্ত্বভিত্তিক অথবা বিমূর্ত চিন্তা করতে আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অপারগ। ফলে আমরা এমএ, এমবিএ, এমএসসি—এ রকম বড় বড় ডিগ্রি দিয়ে তাদের বাজারে ঠেলে দিচ্ছি, অথচ নিজের দেশেই বিদেশিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা পেরে উঠছে না। আমরা অনেকে হয়তো জানি না, ভারত-শ্রীলঙ্কা-কোরিয়া এসব নানা দেশ থেকে আসা সুপার ম্যানেজাররা আমাদের তৈরি পোশাক, ওষুধশিল্প ইত্যাদি খাতে কাজ করে প্রতিবছর ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলার দেশে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ বিদেশে কর্মরত আমাদের ষাট-সত্তর লাখ শ্রমিক উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার দেশে পাঠাচ্ছেন।

অর্থাৎ আমরা দক্ষ মানবসম্পদ, প্রকৃত মানবসম্পদ তৈরি করতে পারিনি, ভারত-শ্রীলঙ্কা এসব দেশ পেরেছে, অন্তত আমাদের থেকে ভালোভাবে পেরেছে। আমরা কেন পারিনি, তার কয়েকটি কারণ আছে। প্রধান কারণটি হচ্ছে, এ ব্যাপারে আমাদের সরকারগুলো, আমাদের সমাজ ও নানা প্রতিষ্ঠান আন্তরিক হতে পারেনি। মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে অনেক ঠোঁটসেবা দেওয়া হয়, কাজের কাজ হয় না। এবার যে বাজেট ঘোষণা করা হলো, তাতে মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর অর্থমন্ত্রী বেশ
জোর দিলেন।

অথচ যে বরাদ্দ দেওয়া হলো, তা দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বড় চেষ্টা নেওয়া যায় না। দুটি বড় খাত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আমরা প্রতিবেশী সব কটি দেশ থেকে কম খরচ করছি। শিক্ষায় এবার বরাদ্দ প্রকৃত অর্থে কমেছে, অথচ আমাদের শিক্ষা খাতের ব্যাপ্তি ঘটছে, শিক্ষার চাহিদা বাড়ছে। শিক্ষায় বরাদ্দ রয়ে গেল জিডিপির সেই ২ শতাংশের কাছাকাছি। স্বাস্থ্য খাতের ছবিটা আরও করুণ—সেখানে বরাদ্দ আগের বছর যেখানে ছিল জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ, এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৯ শতাংশ, অর্থাৎ ১ শতাংশও নয়। অথচ নেপালে তা ২ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যান্য দেশের কথা না হয় না-ই বলা হলো।

যদি শিক্ষায় বরাদ্দ কম থাকে, তাহলে শিক্ষকদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে আগের বেতনেই। এখন পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষার কল্যাণে টিউশন–বাণিজ্য গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। শিক্ষার্থীরা ছুটবে কোচিং সেন্টারে। পাঠ মুখস্থ হবে, জিপিএ–৫ পাওয়া যাবে, সনদ হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেকটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে পড়ে, অর্ধেকটা বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পড়ে আরও একটা সনদ নিয়ে বেরিয়ে চাকরির বাজারে ঢোকা যাবে। মানবসম্পদ আর সম্পদ হবে না, আপদ না হলেও।

ভালো শিক্ষক না থাকলে ভালো শিক্ষাদান হয় না। ভালো শিক্ষককে ভালো বেতন দিতে হয়। এ হচ্ছে শিক্ষাদর্শনের একটি মূল সূত্র। পাঠ শিখতে হয় আনন্দ নিয়ে। মুখস্থ করা, কোচিং কেন্দ্রে যাওয়া, পরীক্ষা দেওয়ার চক্রে সেই আনন্দ উধাও হয়েছে।

মাদক তরুণদের স্বাস্থ্য কেড়ে নিচ্ছে। সারা দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে শুধু অভাব লেগে থাকে। শিক্ষকেরা যেমন কোচিং করেন, চিকিৎসকেরা করেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস। ফলে আমাদের স্বাস্থ্যের চিত্রটা উজ্জ্বল হতে পারে না।

আমরা যদি সত্যিকার মানবসম্পদ তৈরি করতে চাই, যা দেশটাকে একুশ শতকের মহাসড়ক ধরে ক্রমাগত ভবিষ্যতের সব কটি রঙিন গন্তব্যে নিয়ে যাবে, তাহলে মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে কথা-বক্তৃতা-ঠোঁটসেবার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে কোমর বেঁধে কাজে নামতে হবে। সময়টা এখনই।

Add a Comment