বিসিএসে নিয়োগ-প্রক্রিয়া দ্রুত করা সম্ভব

প্রথম আলো, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯,
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব


বিসিএসে নিয়োগে বিলম্ব নিয়ে কদিন আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, ৩৭তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর সাত মাসেও নিয়োগ হয়নি। আরও জানা যায়, একসঙ্গে চলছে চার বিসিএসের কার্যক্রম। তিনটি সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। আর ৩৭তম বিসিএস জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। খবর অনুসারে, পিএসসি গত বছরের ১২ জুন ৩৭ তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে। এতে ১ হাজার ৩১৪ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। শূন্য থাকা সাপেক্ষে নন–ক্যাডার পদে নিয়োগ পেতে পারেন ৩ হাজার ৪৫৪ জন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে উল্লেখ রয়েছে, ক্যাডার পদে সুপারিশকৃত সবার পুলিশি তদন্ত ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন এখনো তাদের হাতে পৌঁছায়নি। এগুলো শেষ হতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে।

এ চিত্রটি অভিনব নয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির পর সুপারিশ চূড়ান্ত করতে পিএসসি সময় নেয় গড়ে আড়াই বছর। তারপরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশি তদন্তের জন্য আট-নয় মাস সময় নেওয়া অনেকটা নিয়মেই দাঁড়িয়ে গেছে। যেমন ৩৪, ৩৫ ও ৩৬তম বিসিএসে নিয়োগ পর্ব চূড়ান্ত করতে সময় নিয়েছে যথাক্রমে সাড়ে আট, সাড়ে সাত এবং সাড়ে নয় মাস। এতে করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির পর চূড়ান্ত নিয়োগ দিতে সময় লেগেছে তিন বছরের অধিক। ৩০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত আবেদন করা যায়। সে বয়সের প্রার্থীরা আবেদন করে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের বয়স ৩৩–এর অধিক।

যাঁরা এগুলো পরিচালনার দায়িত্বে আছেন তাঁদের বিবেচনায় রাখা দরকার, মানুষ বাঁচে কয় বছর, আর চাকরিজীবনই–বা কত দিনের। ২৩-২৪ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পর্ব চুকিয়ে ২৫-২৬ বছর বয়সেই তো কর্মজীবনে থিতু হওয়া সংগত। এ সময়টাই উদ্দীপনা থাকে সবচেয়ে বেশি। দ্রুত বোঝার ও শেখার বয়সও এটি। আমাদের উপমহাদেশে এ ধরনের নিয়োগ-প্রক্রিয়া ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে চলছে। বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে চাকরিতে যোগদান, মোটামুটি এক বছর সময় নেওয়ার কথা। ভারত ও পাকিস্তানে এখনো এমনটাই আছে। আর আমরা তারুণ্যের মূল্যবান সময়টুকু নষ্ট করছি। এসব বিষয় নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। সবই অরণ্যে রোদন। যারা বছরের নিয়োগ বছরে শেষ করে, তাদেরও তো এ ধরনের প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিকসহ সব পরীক্ষাই আছে। আছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশি প্রতিবেদন দেওয়ার নিয়ম।

উল্লেখ্য, সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় প্রতিবছর নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে কর্মকর্তা নিয়োগ পাচ্ছেন। তাদেরও লিখিত, মৌখিকসহ অনেক পরীক্ষার বিধান রয়েছে। দরকার হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বভাবচরিত্র–সংক্রান্ত প্রতিবেদন। সেগুলো তো ঘড়ির কাঁটার মতো সময় মেনেই চলছে। তাহলে বেসামরিক প্রশাসনে এটা সম্ভব হবে না কেন?

পিএসসির পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। সেখানে সব ক্যাডারের জন্য একত্রে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা। যদি তা না হতো আর যদি বাছাই পর্বটা আরেকটু শক্ত করা যেত, তাহলে সময় বাঁচানো সম্ভব হতো। যেমন ৩৭তম বিসিএসে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত ১ হাজার ৩১৪ জনের মধ্যে সাধারণ ক্যাডারগুলোতে মাত্র ৪৬৫ জন। অন্যরা সবাই কারিগরি, বিশেষায়িত ও শিক্ষা ক্যাডারে। এসব ক্যাডারের জন্য তো ৩৯তম বিসিএসে যেভাবে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেভাবেই প্রিলিমিনারি ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া চলে।
এভাবে আগেও চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ-প্রক্রিয়ানির্বিশেষে সব বিসিএসের মান–মর্যাদা, বেতন–ভাতার কোনো তারতম্য হয় না। পুলিশি প্রতিবেদনের জন্য অকারণ বিলম্বিত না হলে ৩৯ তম বিসিএসের মাধ্যমে সুপারিশকৃত চিকিত্সকেরা বিজ্ঞপ্তির এক বছরের মাথায় চাকরি পেতে পারেন। তেমনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় অন্যান্য কারিগরি, বিশেষায়িত ও শিক্ষা ক্যাডারের পদগুলোর। সাধারণ ক্যাডারগুলোর পদসংখ্যা কম। কিন্তু প্রার্থী থাকেন অনেক।

ভারতের ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের দৃষ্টান্ত অনুসরণে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা থেকে মেধাক্রম অনুসারে শূন্য পদের সর্বোচ্চ ১০ গুণ প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় ডাকা চলে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থা হলে ৩৭ তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষার সুযোগ পেতেন ৪ হাজার ৬৫০ জন। আর সে পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে শূন্য পদে শুধু দ্বিগুণসংখ্যক প্রার্থীকে ভারতে ডাকা হয় মৌখিক পরীক্ষার জন্য। এখানে ডাক পেতেন ৯৩০ জন। ১০টি বোর্ডে দিনে ১০ জন করে মৌখিক পরীক্ষা নিতে ১০ কর্মদিবসই যথেষ্ট হতো। এটা আমাদের দেখে ও ঠেকে শেখা উচিত।

অন্যদিকে দেখা দরকার, চূড়ান্ত পর্বে পুলিশি প্রতিবেদন আর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় এত সময় লাগে কেন। দুটোই তো একই সঙ্গে চলতে পারে। পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্তি থেকে চূড়ান্ত নিয়োগপত্র জারি নিকট অতীতেই দুই মাস সময়ের মধ্যে শেষ করার নজির জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নথিতে রয়েছে। ভারতে কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের উঁচু পদগুলোর সব ক্যাডারে পুলিশি প্রতিবেদনের জন্য নিয়োগ বিলম্বিত হয় দেখে সন্তোষজনক প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে নিয়োগ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারও যৌক্তিক বিরূপ কোনো প্রতিবেদন এলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি চাকরি হারাবেন। তবে সেখানে দলীয় আনুগত্য বা বিভিন্ন সংকীর্ণ বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হয় না। প্রার্থী কোনো ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সংশ্লিষ্ট, এমন কিছু না হলে প্রতিবেদন অনুকূলেই থাকে।

স্মরণে রাখতে হবে, সাধারণত সবাই আবেদন করার আগে বা পরপরই স্নাতকোত্তর পড়াশোনার পর্ব শেষ করে ফেলেন। প্রার্থীদের একটি বড় অংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। নিম্নবিত্তেরও কিছু থাকেন। তখন তাঁদের ছাত্রাবাসের সিটেও থাকা চলে না।

অথচ পরীক্ষা বা বিভিন্ন প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা সন্নিহিত স্থানেই তাঁদের থাকার প্রয়োজন হয়। থাকে না কোনো আয়ের ব্যবস্থা। কেউ কেউ অবশ্য ছোটখাটো চাকরি কিংবা গৃহশিক্ষকতা করেন। বুনতে থাকেন আশার জাল। মেসে থাকা–খাওয়ার খরচ জোটানোই কারও কারও জন্য সংকটের ব্যাপার হয়। এমনও আছেন, কারও অভিভাবক অপেক্ষায় থাকেন সন্তান স্বাবলম্বী হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াবে। প্রক্রিয়ার এ বিলম্বগুলো যদি অনিবার্য হতো, কোনো কথা থাকত না।

কিন্তু কিছু পদ্ধতিগত পরিবর্তন আর পুলিশি তদন্ত ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময়সীমায় বড় ধরনের কাটছাঁট করা যায়। পদ্ধতিগত পরিবর্তনগুলো আমাদের পরিবর্তনবিমুখ সমাজে গ্রহণ করানো একটু কষ্ট হবে। তবে চিকিৎসকদের বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে দ্রুত নিয়োগপ্রাপ্তি দেখে অন্যান্য কারিগরি, বিশেষায়িত আর শিক্ষা ক্যাডার প্রার্থীরা ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। নিয়োগ পর্বে কোটাপদ্ধতি সীমিত ক্ষেত্র ব্যতীত বিলুপ্ত। তাই মেধানুসারে ফলাফল তৈরির কাজটি সহজ হয়ে গেছে। চ্যালেঞ্জ থাকছে কাঠামোগত পরিবর্তন ও পুলিশি তদন্ত আর স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময়সীমা কমিয়ে আনা।

যেকোনো সরকারি মেডিকেল কলেজে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো যায়। এর সংখ্যা এখন ৩৬ টি। ১ হাজার ৩১৪ জনকে ভাগ করে দিলে একটিতে ৩৭ জন করে পড়ে। এতগুলোর দরকারও হবে না। বড় বড় কয়টিতে ২০০ করে দিয়ে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে বলা চলে। তেমনি পুলিশি তদন্ত হতে হবে সময়াবদ্ধ। নচেৎ অনুকূল বিবরণীপ্রাপ্তি সাপেক্ষে ভারতের অনুসরণে নিয়োগ দেওয়া যায়। যৌক্তিক কোনো আপত্তি থাকলে নিয়োগাবসান করা যাবে।

৩৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে সামনের মাসে তিন বছর হবে। অথচ প্রতিটি ক্যাডারে ভিত্তি পদে শূন্যতার কথা জানা যায়। এভাবে আর কতকাল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা চলে। যাঁরা সুপারিশ লাভ করেছেন, বড় কোনো বিপর্যয় না ঘটলে তাঁদের চাকরি হওয়ার কথা। আরও বেদনার কথা, এ ধরনের বিলম্ব কিন্তু কোনো রাজনৈতিক কারণে ঘটে না। প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের হাতেই আটকে আছে এঁদের ভবিষ্যৎ। একটু জোর দিলেই গিঁটটা খুলে যেতে পারে।

তাঁদের চাকরি দরকার, ব্যাপারটি শুধু এমনই নয়। প্রজাতন্ত্রও অপেক্ষা করছে তার নবীন সুশীল সেবকদের জন্য। তাই অপেক্ষার পালা সাঙ্গ করতে বিশেষ একটু নজর দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। আর অন্যগুলোতেও সরলীকরণের জন্য গুণগতমান আপস না করে যৌক্তিক সহজ পথ খুঁজতে হবে। এটা সম্ভব ও সমীচীন।

The End

Add a Comment