পাটশিল্পের সম্ভাবনা
|প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৮
আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান দুটি খাত তৈরি পোশাকশিল্প ও প্রবাসী আয়। এ দুটি খাতকে বলা হয় প্রবৃদ্ধির প্রধান চালক। প্রায় তিন দশক ধরে প্রধানত এ দুটি চালকই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নানা পরিস্থিতির কারণে এ দুটি খাতের আরও সাফল্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালক হিসেবে এ দুটি খাতের সম্ভাবনা এখন শেষের পথে। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে উন্নতি করতে হলে তৈরি পোশাকশিল্প আর প্রবাসী আয়ের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা আমাদের আশাভঙ্গের কারণ হতে পারে। সে জন্য প্রবৃদ্ধির নতুন নতুন চালক অন্বেষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সে রকম একটি চালক হতে পারে ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবে এককালে সমাদৃত আমাদের কৃষিপণ্য পাট। এ রকম সম্ভাবনার কথা বেশ জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হলো এবারের জাতীয় পাট দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনায়। আমাদের দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের পাট উৎপাদিত হয়। আমাদের অর্থনীতির ইতিহাসে এই ‘সোনালি আঁশের’ স্বর্ণযুগের কথা আমাদের স্মরণে আছে।
গত শতকের প্রথম দু-তিন দশকে পূর্ববঙ্গের পাট কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। উপনিবেশ মোচনের অব্যবহিত আগে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর বহুসংখ্যক পাটকল স্থাপনের ফলেও পাট অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশ এখন পাটের ক্ষেত্রে আরেকটি সম্ভাবনাময় সময়ের মুখোমুখি।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর শিল্প-রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে অর্গানিক বা পচনশীল ও নবায়নযোগ্য দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। এদিক থেকে পাটের সামনে বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। বিশ্ববাজারের দিকে তাকালেও পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনা লক্ষ করা যায়। ‘ন্যাচারাল ফাইবার ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের শুরুতে বিশ্ববাজারে প্রতি টন পাটের দাম ১০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। বিলাসবহুল মোটরগাড়ি নির্মাণ করে এমন পাঁচটি বড় কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা তাদের গাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামোর একটা বড় অংশ তৈরি করবে পাটজাত পণ্য দিয়ে।
পাট পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক তন্তু; জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল প্রভৃতি পরিবেশসচেতন ইউরোপীয় দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা ও এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার বাড়িয়েছে এবং বাড়াচ্ছে। শুধু পাটের আঁশ নয়, পাটকাঠি বা পাটের সোলাও আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পাটকাঠি থেকে জ্বালানি হিসেবে চারকোল ও এর গুঁড়া থেকে ফটোকপিয়ার মেশিনের কালি তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া পাট থেকে মণ্ড ও কাগজ তৈরির ক্ষেত্রেও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু পাটের এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা সত্ত্বেও দেশের সরকারি পাটকলগুলো ধুঁকছে; বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিবছর ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা লোকসান গুনছে। এই দুর্দশা কেটে যেতে পারে পাটকলগুলোর সেকেলে ও জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি বদলে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনার মান উন্নত করা হলে। বিশ্ববাজারে বহুমুখী পাটপণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা আমাদের পাটশিল্পের সামনে যে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, তা কাজে লাগাতে হবে এবং সে জন্য এই খাতের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
পাট খাতকে জাতীয় প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালকে পরিণত করা সম্ভব—বিশেষজ্ঞদের এই প্রত্যয় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এ জন্য পাটশিল্পের সহায়ক নীতি প্রণয়ন করতে হবে এবং সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাটপণ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার ও রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে বহুমুখী উদ্যোগ নিতে হবে।