চার দেশ ব্যর্থ যে কারণে..
|প্রথম আলো, ০৯ জুন ২০১৮
২০১৭ সালের ৫ জুন কাতারবাসীর ঘুম ভাঙে একটি দুঃসংবাদে। তাদের দেশের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। আর অবরোধকারীরা দূরের কেউ নয়, প্রতিবেশী তিন আরব দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইন এবং তাঁদের মিত্র মিশর। এই রাষ্ট্র চতুষ্টয় তড়িঘড়ি কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় বাণিজ্য ও ভ্রমণে।
কাতার সরকারের পতন ত্বরান্বিত করতে বা নিদেনপক্ষে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে ‘আঘাত ও ভয়ের’ কৌশল নেওয়া হয়। কাতারভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশন চ্যানেলের ওয়েবসাইটে এক নিবন্ধে বলা হয়, কাতারের কাছে তখন ১৩টি দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: আলজাজিরা গণমাধ্যম নেটওয়ার্ক বন্ধ করা, ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, কাতারের রাজধানী দোহার কাছে স্থাপিত তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা। কাতারের নীতির কারণে বছরের পর বছর অবরোধ আরোপকারী দেশগুলোর যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ দিতেও বলা হয়।
পরে জানা যায়, ওই চার দেশ কাতারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের কথাও বিবেচনা করছিল। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সতর্কতার মুখে তারা থমকে যায়। এখানে বলা প্রয়োজন, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি কাতারে অবস্থিত।
আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজের পলিসি অ্যানালাইসিসের পরিচালক মারওয়ান কাবালানের লেখা নিবন্ধে বলা হয়, সৌদি আরবের নেতৃত্বে কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় কাতার বিস্মিত ও অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তবে এই অবরোধ দেশটিকে দমিয়ে রাখতে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে এবং দোহা দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।
কেন কাতারের ওপর অবরোধ
গত বছরের ৫ জুন অবরোধ আরোপের আগে থেকেই উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) সদস্য দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এর আগে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরব, ইউএই ও বাহরাইন তাদের রাষ্ট্রদূতদের দোহা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ না করার’ নিরাপত্তা চুক্তিটি কাতার মানেনি।
দোহার স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতিতে রিয়াদ ও আবুধাবি বিরক্ত হয়। তবে ওবামা প্রশাসনের সহানুভূতি না পেয়ে সৌদি আরব ও ইউএই তখন কাতারের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অবরোধের কারণে কাতারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হতে পারত। ব্লুমবার্গের হিসাবে, এর পরিমাণ ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। কিন্তু তা না হয়ে বরং দেশটি আগের চেয়ে আরও বেশি স্বাধীন ও স্বনির্ভর হয়েছে। দোহা তখন বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপনেরও উদ্যোগ নেয়। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আলথানি তখন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সবকিছু নতুন করে শুরু করার ইচ্ছা পোষণ করেন। ২০১৪ সালের নভেম্বরে রিয়াদ চুক্তি শেষ হলে জিসিসির তিনটি দেশ তাদের রাষ্ট্রদূতদের দোহায় ফেরত পাঠায়। এবং ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কাতারের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত জিসিসির বার্ষিক সম্মেলনে সৌদি আরব, ইউএই ও বাহরাইনের নেতারা যোগ দেন।
২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট হুথি বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে হামলা চালালে কাতার তাদের সমর্থন জানায় এবং ইয়েমেনে সৈন্য পাঠায়। সৌদি আরবের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে কাতার তখন তেহরান থেকে রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়। এ পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীরা তেহরানে সৌদি আরবের দূতাবাসে হামলা চালায়। কাতার সরকার বাহরাইনকে আর্থিক সহায়তা করার বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছিল। এ ব্যাপারে আলোচনা করতে বাহরাইনের প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স খলিফা বিন সালমান আলখলিফা ও বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স সালমান আলখলিফা ২০১৭ সালের
ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দুই দফায় দোহা সফর করেন।
জিসিসি সংকটের এক বছর: গালফ অর্থনীতিতে প্রভাব কী?
২০১৪ সালের সংকটের পর দোহার লক্ষ্য ছিল, জিসিসির তিন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ধীরে ধীরে উন্নত করা। আগের তিক্ততা ভুলে তখন দেশটি জিসিসির তিন দেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক শুরুর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু স্বস্তি মেলে স্বল্প সময়ের জন্য। ওবামা প্রশাসনের সমর্থন না পেয়ে তখন ওই তিন দেশ আঘাত হানার কুঠারটি সাময়িক সময়ের জন্য মাটি চাপা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আরেকটি সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর এ চিত্র নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়। হোয়াইট হাউসের নতুন প্রেসিডেন্ট তাদের সহযোগিতা করার আগ্রহ দেখায়। এ পর্যায় রিয়াদ ও আবুধাবি আবার সংঘর্ষে জড়াতে উৎসাহিত হয়।
অবরোধে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলল না কেন
সব চাপ সত্ত্বেও কাতার অনেককে বিস্মিত করে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রাথমিক আঘাত সামলে নিয়ে তারা সমন্বিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করল। কাতারের মূল লক্ষ্য ছিল, সম্পর্কের বরফ গলানো এবং অবরোধ আরোপকারী দেশগুলোর শত্রুতামূলক কাজ ঠেকিয়ে দেওয়া। কাতারের প্রচারের কেন্দ্র ছিল ওয়াশিংটন। কয়েক মাসের কঠোর পরিশ্রমে দেশটি ট্রাম্পের অবস্থান বদলাতে সফল হয়। কাতার নিরাপত্তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় অঙ্গীকার আদায়ে সক্ষম হয়। ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্র-কাতার প্রথম বার্ষিক কৌশলগত সংলাপের পর গত ৩০ জানুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর একটি বিবৃতি দেয়। তাতে কাতারের ভূ-খণ্ডগত অখণ্ডতার প্রতি বাইরের যেকোনো হুমকি মোকাবিলা ও লড়াইয়ে কাতারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়।
জিসিসির কী অবশিষ্ট আছে?
তুরস্কের সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি বাস্তবায়ন করল কাতার। এর ফলে তুরস্ক কাতারে সামরিক ঘাঁটি সম্প্রসারণের সুযোগ পেল। এ চুক্তি সই হয়েছিল ২০১৪ সালের সংকটের সময়। এ কারণে ইরান সে দেশের আকাশ ব্যবহার করে দোহায় উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কাতার ইরানের রাষ্ট্রদূতকে তেহরানে ফেরত পাঠায়।
অবরোধ আরোপকারী দেশগুলোর মধ্য দিয়ে পণ্য আনা বন্ধ হয়ে গেলে ইরান হয় কাতারের খাদ্য, পানি ও ওষুধ সরবরাহের একমাত্র পথ। এ দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য গত বছর নাটকীয়ভাবে বেড়ে ২০০ কোটিতে পৌঁছায়।
এভাবে এই সংকট অবরোধ আরোপকারী দেশগুলোর আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত ফল নিয়ে আসে। ইরানের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক অবনতির পরিবর্তে বরং শক্তিশালী হয়েছে। কাতারে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে তুরস্ক প্রথমবারের মতো উপসাগরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হয়েছে। আলজাজিরা এখনো চালু আছে এবং ওই চার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রচার অব্যাহত রেখেছে।
এমনকি লাখ লাখ ডলারের সৌদি-ইউএই জনসংযোগ প্রচারও কাতারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। দেশটির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগানোর কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার অভিযোগ তুলেও তারা কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি। উপসাগরীয় ওই দুই দেশ গোপন তথ্য-যুদ্ধ চালিয়ে কাতারকে হুমকি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা ও তার প্রতি মার্কিন নীতি পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে। কাতারবিরোধী কর্মসূচির আয়োজনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেছে জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও তদবিরকারী দল ভাড়ায়।
গণমাধ্যমে কাতারবিরোধী প্রচারণা চালাতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এসসিএল গ্রুপের (রাজনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ অ্যানালাটিকার মূল প্রতিষ্ঠান) মতো রাজনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত করেছে। কিন্তু এসব চেষ্টা তেমন কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি। এসবের পাশ কাটিয়ে সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে কাতার গত বছরের জুলাই মাসে আমেরিকার সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে।
অবরোধের কারণে কাতারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হতে পারত। ব্লুমবার্গের হিসাবে, এর পরিমাণ ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। কিন্তু তা না হয়ে বরং দেশটি আগের চেয়ে আরও স্বাধীন হয়েছে। কাতারের অধিকাংশ বাসিন্দা এখন মনে করেন, তারা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করেছেন।