অদক্ষতার খেসারত বেড়েই চলেছে***
|প্রথম আলো, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
মুনির হাসান, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
কোনো দেশে যখন কাজের লোকের অভাব হয়, তখন সেখানে অন্য দেশের লোকেরা হাজির হয়। এটিই নিয়ম। আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি লোক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। সাধারণভাবে জনবহুল দেশ কম লোকের দেশে জনশক্তি সরবরাহ করে। বিশ্বে রেমিট্যান্সের প্রবাহ হয় উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২০১৫ সালের চেয়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ কমে মোট ৪২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার (৪২৯ বিলিয়ন) হয়েছে। আর এর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশ ভারতের রেমিট্যান্স কমেছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ (মোট রেমিট্যান্স ৬ হাজার ২৮০ কোটি ডলার)। তবে ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের অন্য একটি চিত্র আমাদের সম্পূর্ণ হতবাক করে দিতে পারে। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত থেকে আমরা প্রথম জানতে পারি যে ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের পঞ্চম শীর্ষ দেশটি হলো বাংলাদেশ (২০১৪ সালে যার পরিমাণ ৪০৮ কোটি ডলার) ! দুঃখের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রেমিট্যান্স প্রবাহ এই কয়েক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। গত ১৯ জানুয়ারি এক সেমিনারে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের শিল্প খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যেসব ভারতীয় নাগরিক কাজ করেন, তাঁরা বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা (৪০০ কোটি ডলার) বৈধ পথে ভারতে নিয়ে যান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে আলাপের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, অবৈধ পথে যে টাকা যায়, তা বিবেচনায় নিলে মোট পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। (বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা ভারতে চলে যাচ্ছে, প্রথম আলো, ২০ জানুয়ারি ২০১৮)
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশে কেন দক্ষ জনগোষ্ঠীর ঘাটতি হবে আর তার খেসারত দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে? উত্তরটা সহজ। একটি দেশের অর্থনীতি যখন বড় হতে থাকে, তখন সেটির কর্মবাজার বড় হতে থাকে। এবং সেটি কেবল আড়াআড়িভাবে নয়, ওপর-নিচেও বড় হয়। হিসাব বলে, আগামী ২০২৩ সাল নাগাদ আমাদের প্রবৃদ্ধির এই হার বজায় থাকলে বছরে কমপক্ষে এক লাখ মধ্য ও উচ্চপর্যায়ের কর্মীর প্রয়োজন হবে। বর্তমানে ডজনখানেক বহুজাতিক ও দেশীয় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান মিলে সে সময় হয়তোবা হাজার বিশেক মধ্যপর্যায়ের কর্মী তৈরির সক্ষমতা তৈরি হবে। বাকি ৮০ হাজার? ভারত, শ্রীলঙ্কা বা সে রকম দেশ থেকে আসবে। শ্রীলঙ্কাও আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি করে। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন দেখি ঢাকা-কলম্বো নিয়মিত বিমান যোগাযোগ ১০ বছর আগের তুলনায় পাঁচ গুণ বেড়েছে! গত ১০ বছরে নতুন করে বেড়েছে চীনা কর্মীদের ব্যাপক আনাগোনা।
বৈশ্বিক গ্রামে দক্ষ কর্মীরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক এবং সেখানে জোর করে বাধা দেওয়ারও কিছু নেই। যে দেশে প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মবাজারে প্রবেশ করেন, সেখানে কেন হরেদরে কর্মীরা বিদেশ থেকে আসবেন? বিদেশি বিশেষজ্ঞ থাকবেন, নতুন প্রযুক্তিকর্মী থাকবেন, কিন্তু ম্যানেজার কিংবা ফ্লোর ম্যানেজার কেন বিদেশ থেকে আসবেন? এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঁধে দোষ চাপানোর সুযোগ নেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়-উত্তীর্ণ সদ্য স্নাতক শিক্ষার্থীদের বিষয় এটি নয়। মধ্য ও উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মী প্রকৃতপক্ষে ‘গাইতে গাইতে গায়েন’ হয়ে ওঠেন। এ জন্য প্রথমত তাঁকে উচ্চতর পদে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, যেন তাঁর দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেন। এর জন্য তাঁকে নিয়োগকর্তার আস্থাও অর্জন করতে হয়। ঠিক এই জায়গাতেই আমরা হয়তো ঠিকমতো কাজ করতে পারছি না। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়ালে তাঁরা অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাবেন। যদি অনেক কর্মীর দক্ষতা বাড়ানো না যায়, তাহলে সংখ্যাস্বল্পতার সুযোগে এই বাজারে কর্মীদের চড়া মূল্য দিয়েই কিনতে হবে নিয়োগকর্তাকে। এই সমস্যার উত্তরণ ঘটানোর রাস্তা হলো বিপুলসংখ্যক কর্মীকে নিয়মিত পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ দেওয়া।
কমবেশি একই সময়ে শুরু হওয়া আমাদের দুটি সেক্টরের তুলনামূলক চিত্র থেকে দুর্বলতাটা ধরা যায়। আশির দশকে ডানা মেলতে শুরু করে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প ও বেসরকারি ব্যাংক। তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশের সূচনাটা করেন প্রয়াত কর্মবীর দেশ গার্মেন্টসের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল কাদের (ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে আমাদের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এ কারণে এই কর্মবীরকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করার কোনো চেষ্টা আমার চোখে পড়েনি)। কেবল যন্ত্রপাতি এনে তিনি কারখানা চালু করেননি; বিশ্ববিদ্যালয়-উত্তীর্ণ ১৩০ জন তরুণ-তরুণীকে কোরিয়া থেকে হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে এনেছেন। ফলাফল, আমাদের কর্মবাজারে সবচেয়ে বড়টি এই পোশাকশিল্প, যার সম্পূর্ণটি বেসরকারি উদ্যোগ। একই সঙ্গে বিদেশি কর্মীর সংখ্যাও কিন্তু এই খাতে সবচেয়ে বেশি। ভারত ও শ্রীলঙ্কান কর্মীদের ৮০-৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্পে কাজ করেন।
অথচ বেসরকারি ব্যাংকের বেলায় চিত্রটি একই রকম নয়, যেখানে সিংহভাগই বেসরকারি উদ্যোক্তা। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, ব্যাংক খাতে বিদেশি কর্মী নেই বললেই চলে। এর অন্যতম কারণ হলো দেশে ব্যাংকারদের পেশাগত মানোন্নয়নের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, কোর্স আর কর্মশালার আয়োজন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে। এমনকি ব্যাংকিং বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টও গড়ে উঠেছে। অতিথি বক্তা হিসেবে মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, কেবল আধুনিক ব্যাংকিং ধারণা নয়, তথ্যপ্রযুক্তি এবং এ-সংক্রান্ত নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির প্রতি তাদের সজাগ দৃষ্টি আছে।
গার্মেন্টসের বেলায় কেন এমন একটা চমৎকার ইকোসিস্টেম গড়ে উঠল না, তা ভেবে দেখা দরকার। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটির জন্য কর্মী তৈরি করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ হয়তো নেই বা থাকলেও খুবই অপ্রতুল। অথচ যদি এ দুই খাতে কর্মীদের মানোন্নয়নের জন্য বছরে মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়, তাহলে সেটি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বছরে কমপক্ষে ১৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করবে।
বিশ্বব্যাপী এটি সুবিদিত যে বড় কোম্পানির জন্য দক্ষ কর্মী সরবরাহের কাজটি করবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশে তেমন কাউকে দাঁড়াতে দেখা যায় না। একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাঁর উদ্যোগ সম্প্রসারণের জন্য প্রশিক্ষণ, পুঁজি কিংবা বাজার সহায়তার কোনোটিই সময়মতো পান না। অতি সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে একটি উদ্যোক্তা একাডেমি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। তবে সেটি কেবল তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য।
তাই হয়তো দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নিজেদের নানা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’-এমন একটি গ্রুপের প্রায় ৭০ হাজারের বেশি সদস্য পরস্পরকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। তাঁদের স্লোগানটিও বর্তমানে খুবই জোরালো হয়ে উঠেছে। এসব উদ্যমী তরুণের ‘পথে নেমে পথ চেনা’ সফল হবে, যদি আমরা তাঁদের পাশে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারি। তখনই কেবল বছরে বছরে দক্ষতা ঘাটতির পরিমাণ দেখে আমাদের আঁতকে উঠতে হবে না।