সিরিয়ায় তুরস্কের বহুমুখী কৌশল

সাম্প্রতিক সময়ে জটিল এক যুদ্ধ হচ্ছে সিরিয়াতে। সিরিয়া ফ্রন্টে বাশার আল-আসাদের বাহিনী, আইএস, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি, কুর্দিদের পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট প্রকাশ্যে যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরানেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সিরিয়ার ময়দানে কে কার পক্ষে বা বিপক্ষে যুদ্ধ করছে, সেটি নির্ণয় করা বেশ জটিল ও দুরূহও।

তুরস্কের কথাই ধরা যাক। সিরিয়ার যুদ্ধে প্রথম দিকে তুরস্কের অবস্থান ছিল সরাসরি বাশারের বিপক্ষে। বাশারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামীদের ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে তুরস্ক সমর্থন দিয়েছে। যুদ্ধ শুরুর সাত বছর পর তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সমঝোতা প্রক্রিয়া আস্তানা প্রসেসে যুক্ত হয়েছে। রাশিয়া ও ইরান বাশারকে ক্ষমতায় রেখেই সমাধানের পক্ষে।

সিরিয়ার যুদ্ধে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে আইএসের ওপর হামলা করছে, আবার বছরে শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কুর্দিদের ওপরও হামলা করছে রাশিয়ার সহায়তায়। সিরিয়ার যুদ্ধ ও ২০১৬ সালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর দেশটি পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তুরস্কের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে দুইভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক ক্রমেই রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং সিরিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের জটিল ও বহুমুখী অংশগ্রহণ। এসব পরিবর্তন হচ্ছে তুরস্কের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আধুনিক অটোমান সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিলাষ।

ন্যাটোর সদস্য হিসেবে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ অ্যান্টি ব্যালাস্টিক সিস্টেম সংগ্রহ করা অনেক উচ্চাভিলাষী আচরণ। স্বভাবতই ন্যাটো সরাসরিই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ এটিকে জটিল বিষয় বলে চিহ্নিত করেছেন। ন্যাটোর আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় কীভাবে এই নয়া মিসাইল সিস্টেমকে সমন্বয় করা হবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের জন্য তুরস্ক বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের দায়ী করেছে।

ওই অভ্যুত্থান-চেষ্টার পর রাশিয়ার সঙ্গে সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে তুরস্ককে অবস্থান বদলাতে উসকে দেয়। সম্প্রতি সিরিয়ার উত্তর সীমান্তে আইএস ক্রমাগত পশ্চাদপসরণ করলে তুরস্কে ওই অঞ্চলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ বছরের জানুয়ারির মধ্যভাগে তুরস্ক সিরিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আফরিনে ‘অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চ’ শুরু করে পিপলস প্রটেকশন ইউনিটের বিরুদ্ধে। তুরস্কের সহায়তায় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ৫৮ দিনের যুদ্ধ শেষে ১৮ মার্চ আফরিনে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এখানে মজার বিষয় হচ্ছে, আফরিনে কুর্দিদের সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার তুরস্ক ও ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে সহায়তা করছে রাশিয়া।

আইএস ছাড়াও সিরিয়ার কুর্দিদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে তুরস্ক। দেশটি চায় না যুদ্ধ শেষে সিরিয়ার কুর্দিরা স্বায়ত্তশাসন অর্জন করুক। এতে তুরস্কের কুর্দিরা উৎসাহিত হবে। ১৯৮০ সাল থেকে তুরস্ক নিজ দেশের কুর্দিদের দমন করছে। এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষের ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এদের বেশির বেশির ভাগই কুর্দি। অসংখ্য কুর্দিকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। অনেক কুর্দিই তুরস্ক থেকে পালিয়ে গেছেন। তুরস্কের বিভিন্ন সময় সরকারের পরিবর্তন হলেও কুর্দিনীতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি ২০১৫ সালের আগে। উদারপন্থী বা এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী; যেই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। তবে এরদোয়ান কয়েক বছর ধরে তুর্কি কুর্দিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। কুর্দিনীতিতেও পরিবর্তন এনেছেন। কুর্দি অঞ্চলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন, কুর্দিদের ভাষার অধিকার ও কুর্দি গ্রামগুলোর কুর্দি নাম ব্যবহারের অধিকার দিয়েছেন। এর জন্য এরদোয়ান নিজ দল একেপির ভেতরে সমালোচিতও হয়েছে। শুধু নিজ দলই নয়, বিরোধী পক্ষও তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত করে থাকে। তবে কুর্দি এলাকায় এরদোয়ানের ভোট বেড়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনে এরদোয়ান কুর্দিদের ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

বস্তুত, এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনীতি সিরিয়ায় কুর্দি ও আইএস উভয়কেই হুমকি হিসেবে দেখে থাকে। ইতিমধ্যেই তুরস্কে কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলাও হয়েছে।

সিরিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের স্বার্থগুলো কী কী? তুরস্ক কেন এই জটিল যুদ্ধের মধ্যে নিজেকে ঢেলে দিয়েছে? সিরীয় ফ্রন্টে তুরস্ক আসলে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চাইছে। প্রথমত, সিরিয়ার আফরিনসহ উত্তরাঞ্চলে আরব সুন্নিদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। তুরস্কে ২০ লাখের বেশি সুন্নি সিরীয় উদ্বাস্তু রয়েছে। এদের কুর্দিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছে তুরস্ক। এতে দীর্ঘদিনের কুর্দি সমস্যার সমাধান হবে। রাশিয়ার সঙ্গে যোগ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বেরিয়ে আসা। সিরিয়া সংকটের সমাধানে নেতৃত্ব দিয়ে মুসলিম বিশ্বে নিজের স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি গড়ে তোলা বা মোড়ল হিসেবে আবির্ভূত হওয়া।
মুসলিম বিশ্বের মোড়ল হওয়ার দৌড়ে ইরানের সঙ্গে আবার তুরস্কের প্রতিযোগিতাও রয়েছে। উভয় দেশই চায় সিরিয়ায় ‘পাওয়ার ব্রোকার’ বা শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে। ইরান বা সিরিয়া; যার মধ্যস্থতায় সিরিয়ার যুদ্ধের সমাধান হবে, সন্দেহাতীতভাবে ওই দেশটির আঞ্চলিক ক্ষমতা বাড়বে। যদি ইরানের মধ্যস্থতায় শান্তি আসে, তবে সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। ইরানের প্রভাব ইসরায়েলের আরও কাছে চলে যাবে। গোটা এলাকায় হিজবুল্লাহর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি তুরস্ক কতটুকু মেনে নেবে, সেটি দেখার বিষয়।

সিরিয়ার যুদ্ধ তুরস্কের জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাব নিয়ে আসতে পারে। যদি তুরস্কের পরিকল্পনা সফল হয়, তবে নিঃসন্দেহে তুরস্কের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়বে। কিন্তু ন্যাটো জোটে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয়ের বাইরে যাওয়া তুরস্কের জন্য স্বস্তিকর না-ও হতে পারে। ইতিমধ্যেই একবার অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তুর্কি কুর্দিদের প্রতি সহায়তা বাড়িয়ে দিতে পারে। তুরস্কের ওপর নানা ধরনের অবরোধ আরোপ করতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা।

সম্প্রতি তুরস্ক নিয়ে একটি কথা বিশ্লেষকেরা বেশ আলোচনা করছেন। তুরস্ক কি ন্যাটো জোটে থাকবে, না বেরিয়ে যাবে? এর উত্তর পাওয়ার জন্য সিরিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মোকাবিলা করে এরদোয়ান কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তার ওপরও এই প্রশ্নের উত্তর অনেকটা নির্ভর করে।

সংগ্রহঃ প্রথম আলো, ৩০ মে ২০১৮
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি

Add a Comment