চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ। প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কী?
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আরেক নাম ডিজিটাল শিল্পবিপ্লব। বর্তমানে আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনো হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া। ডিজিটাল বিপ্লব কী, সে বিষয়টির বিশদ একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন World Economic Forum এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব, তার The Fourth Industrial Revolution নামক বইয়ে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে বলে তিনি মনে করেন।

ক্লাউস শোয়াব তার গ্রন্থে ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে যে সকল পরিবর্তন হবে বলে আশা করেন সেগুলর এটি তালিকা দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে-

১. পেসমেকারের মত যে শরীরে মোবাইল ফোন বসানো হবে।
২. চশমার সঙ্গে, পোশাকের সঙ্গে ইন্টারনেট যুক্ত থাকবে।
৩. ৯০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। তাদের পকেটেই থাকবে সুপার কম্পিউটার।
৪. ইন্টারনেট অব থিংস এর বহুল ব্যবহার।
৫. চালকবিহীন গাড়ি।
৬. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
৭. রোবোটিকস।
৮. বিটকয়েন ও ব্লকচেইন এর মত বিকল্প টাকা যা কাগুজে টাকার ব্যবহার কমাবে।
৯. ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার খুব সস্তা হবে। ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের মাধ্যমে মানুষের চিকিৎসা হবে। প্রথম থ্রি-ডি প্রিন্টার থেকে নেওয়া যকৃৎ মানুষের শরীরে বসানো হবে।
১০. ৫ শতাংশ ভোগ্যপণ্য থ্রি-ডি প্রিন্টার থেকেই বানিয়ে নেওয়া যাবে।
১১. প্রথম মানবশিশু জন্ম নেবে, যার জিনোম কৃত্রিমভাবে উন্নততর করা হয়েছে।
১২. মানুষের মস্তিষ্কে কৃত্রিম স্মৃতিভান্ডার বসানো হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সমস্যাঃ
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সব থেকে বড় সমস্যা যেটা তাহল কর্ম সংস্থান। চালকহীন গাড়ী যদি রাস্তায় চলে তবে লক্ষ লক্ষ ড্রাইভার, হেল্পার কর্মহীন হয়ে পড়বে। কলকার খানায় রোবটের ব্যবহার বাড়লে, শ্রমিকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। ফলে কোটি কোটি শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ পোশাক শ্রমিক চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসবে। অফিস আদালতে পিওনের কাজ রোবট করলে হাজার হাজার MLSS(Member of Lower Subordinate Staff) চাকরি হারাবে।

প্রযুক্তির অগ্রগতি আমরা কেউ রুখতে পারবো না, সভ্যতার উন্নয়নে তা ঠিকও নয়। প্রযুক্তি যেমন সর্বদা গতিশীল মানুষকেও তেমন গতিশীল হতে হবে। নিজকে প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে প্রযুতি বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জোয়ার মানুষকে ভাসিয়ে নিতে না পারে। বরং মানুষই মানুষের ভালোর জন্য, উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দারিদ্র্য বিমোচনের দারুণ এক উপলক্ষ হতে পারে। এ জন্য স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন খাতে, বিভিন্ন আঙ্গিকের ব্যবহার আয়ত্ত করতে হবে আমাদের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে মানুষের আয়ু বাড়বে আর তাতে স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ হতে পারে সবচেয়ে বেশি। সেই বিষয় সামনে রেখে তরুণদের স্বাস্থ্য খাতসহ নতুন নতুন উদ্যোগ ও নতুন দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া দরকার।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সুযোগ না সংকট?
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তরুণেরা এমনিতেই সচেতন, তারা নতুনকে দারুণভাবে কাজে লাগাতে পারে। তরুণদের কাজ দেখানোর সুযোগ করে দিলে, উৎসাহ দিলে তারা ইতিবাচকভাবেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে গ্রহণ করবে। তরুণদের নানামাত্রায় সুযোগ আসবে সামনে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তরুণদের চিন্তাশক্তি বিকাশের জন্য নানা সুযোগ তৈরি করা দরকার, যাতে তারা নিজেদের তৈরি করে নিতে পারে।

যন্ত্র বনাম মানুষের যুদ্ধ
আগের তিনটি শিল্পবিপ্লবে যন্ত্র দিয়ে মানুষ বদলে ফেলেছে নিজের দৈনন্দিন কাজ ও সভ্যতাকেও। যন্ত্র আর মানুষ নিজ নিজ অবস্থানে স্বতন্ত্র। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এ বিভাজনের দাগটাকে মুছে ফেলছে। এখন প্রতিদিনই কোটি কোটি মানুষকে যন্ত্রের কাছে পরীক্ষা দিতে হয় ‘আমি রোবট নই’ বলে প্রমাণ করে। কারও কারও ধারণা, যন্ত্র বনাম মানুষের যুদ্ধে প্রযুক্তির নান্দনিকতায় মানুষ অনেকটাই পিছিয়ে পড়তে পারে। তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ, সমস্যা সমাধানকেন্দ্রিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিৎ। প্রযুক্তি খুব দ্রুত জায়গা করে নেয়। প্রযুক্তিকে ইতিবাচক উপায়ে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষতা বিকাশে মনোযোগ দিতে হবে। বিভিন্ন সমস্যার নান্দনিক সমাধানের জন্য সার্বিকভাবে সহায়ক পরিবেশের দরকার।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ
দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার তরুণদের উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কেবল অর্থায়ন নয়; বরং মেন্টরিং, আইনি সহায়তা থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠার জন্যও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে বিভিন্ন শিল্প খাতে নানামাত্রায় ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলে সেখানকার পরিবেশটিই উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোর পরিবেশ। এরকম পরিবেশ সৃষ্টিতে আমাদেরকে মনযোগী হতে হবে, আর তা হবে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবেলায় বহুমাত্রিক সৃজনশীলতার বিকাশে নিচের দক্ষতাগুলো কাজে লাগতে পারে-

* জটিল সমস্যা সমাধানে দক্ষতা
* ক্রিটিক্যাল চিন্তা
* সৃজনশীলতা
* জনব্যবস্থাপনা
* অন্যদের সঙ্গে সমন্বয়
* আবেগীয় বুদ্ধি
* বিচার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা
* সেবামুখিতা
* চুক্তির দক্ষতা
* খাপ খাওয়ানোর জ্ঞান

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব থেকে সুবিধা নিতে আমরা যা যা করতে পারি-
* সারা দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবস্থা
* বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প খাতগুলোর মধ্যে গবেষণাকেন্দ্রিক সম্পর্ক স্থাপন, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি
* বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অধিক হারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য সুযোগ প্রদান
* সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সুযোগ বাড়াতে হবে। অর্থায়নের পাশাপাশি মেন্টরিং, আইনি সহায়তা এবং মার্কেটে প্রবেশাধিকারের সহায়তাও তাদের দরকার
* শিক্ষার্থী ও তরুণদের ব্যবহারিক শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। পলিটেকনিক ঘরানার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি ও বিকাশে গুরুত্ব দিতে হবে
* বহুমাত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ রাখতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতের পাশাপাশি সামাজিক বিজ্ঞান, লিবারেল আর্টস, নন্দনকলার বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ বাড়াতে হবে। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর আলোকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু
* শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন খাতে বর্তমান সমস্যাগুলোকে প্রযুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে সমাধানে গুরুত্ব দিতে হবে
* প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের জন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে

Add a Comment