অক্টোবর বিপ্লব

এই পোস্টটি পড়ার আগে অবশ্যই রুশ বিপ্লব পোস্টটি পড়বেন।

অক্টোবর বিপ্লব(October Revolution)- সোভিয়েত ইতিহাস চর্চায় যাকে মহান অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলা হয়। অক্টোবর বিপ্লব ছাড়াও এ বিপ্লবের আরও কিছু নাম আছে, যেমন- অক্টোবরের গণ-অভ্যুত্থান, অক্টোবরের ক্যু, বলশেভিক বিদ্রোহ বা রেড অক্টোবর। পুরাতন রীতির ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর, ১৯১৭ (নতুন ক্যালেন্ডার অনুসারে ৭ নভেম্বর) তারিখে এক সশস্ত্র গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ বিপ্লব সংঘটিত হয়। বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন বলশেভিক পার্টি ও এর নেতা ভ্লাদিমির লেনিন।

অক্টোবর বিপ্লবের পটভূমি

ফেব্রুয়ারির এ বিপ্লব অত্যন্ত দ্রুততার সাথে রক্তপাতহীন অবস্থায় শেষ হয়। ফলে জনগন একটি ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক রাশিয়ে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। জাতীয় পরিষদ দ্যুমার সদস্যরা একটি অন্তর্বর্তিকালীন সরকার গঠন করে। এই অন্তর্বতীকালীন সরকার ততদিন ক্ষমতায় থাকবে যতদিন না Constituent Assembly নিরবাচন হয়। নির্বাচিত এই Constituent Assembly রাশিয়াকে একটি সংবিধান দেওয়ার কথাও ছিল। দুঃখের বিষয় হল প্রথম অধিবেশনেই অনেক তর্ক-বিতর্ক তা থেকে মতানৈক্য ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে এই গণপরিষত ভেস্তে যায়। ফলে প্রথম অধিবেশনটাই হয় শেষ অধিবেশন।

অক্টোবর বিপ্লবের নেতা

সে সময়ে সবগুলো সোভিয়েতের মধ্যে পেট্রগার্ড সোভিয়েত ছিল শক্তিশালী। এই সোভিয়েত গঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী, মেনশেভিক(মার্ক্সিস্ট) ও বলশেভিক পার্টির দ্বারা। স্বভাবতই এই সোভিয়েতে শ্রমিক ও সৈনিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কোন অভিজাত শ্রেণি ছিল না। এই পেট্রগার্ড সোভিয়েতই রাজধানীর সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। বলশেভিক পার্টির নেতা ভ্লাদিমির লেনিন যিনি ১৬ বছরের নির্বাসন থেকে কেবল ফিরেছেন- তিনি এসেই এ সাম্রাজ্যবাদী প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের বিরোধীতা শুরু করলেন। (৩৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি) সেই সাথে জমিদারদের কাছ থেকে ভূমি ছিনিয়ে নিয়ে কৃষকদের মাঝে বিতরণ, বুর্জোয়া অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে পিপলস সোভিয়েত কে দেওয়ার দাবী জানান। উল্লেখ করতে হয় যে তখন সমগ্র রাশিয়া জুরে সোভিয়েতদের সমর্থন ও প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বলশেভিক পার্টির মূল স্লোগান ছিল “খাদ্য, শান্তি ও জমি”। অর্থনৈতিক ও সামরিক সংকটের সময় এ স্লোগান বেশ ভালো সাড়া ফেলেছিল।

অক্টোবর বিপ্লব

প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের এক পর্যায়ে রাশিয়ার প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায় এবং চার লক্ষাধীক লোক হতাহত হয়। অনেক সৈন্যের নৈতিক মনবল ভেঙ্গে যায় কেউ কেউ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়, সৈনিক ও নাবিকরা পেট্রোগার্ড এ বিদ্রোহ করে শ্রমিকদের সাথে রাস্তায় নামে। শ্রমিক সৈনিক ও নাবিকদের এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় বলশেভিক পার্টি। যে সকল সৈন্য অন্তর্বতীকালীন সরকারের অধীনতা স্বীকার করে তারা বিক্ষোভে গুলি করে জনসাধারণকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তারপর রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী সাড়াসি অভিযানে নামে এবং বলশেভিক পার্টির অনেক নেতা কে গ্রেফতার করে। এ সময় ভ্লাদিমির লেনিন নকল পাসপোর্ট তৈরি করে ফিনল্যান্ডে পালিয়ে যান।

আর্মি কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল কর্নিলভ মনে করতেন দেশের অভ্যন্তরের সংঘাতময় পরিস্থিতি সৈনিকদের মনবল দুর্বল করে দিচ্ছে। তিনি ভ্লাদিমির লেলিনকে একজন জার্মান গুপ্তচর মনে করতেন। জেনারেল আরও মনে করতেন যে লেলিনের মত লোকেরা এই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে ব্যবহার করে কুটচাল চালছেন। তাই অভ্যন্তরিণ আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়া আনতে জেনারেল তার সৈন্যদেরকে পেট্রোগার্ডের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন।

বলশেভিকরা সম্ভাব্য এই মিলিটারি ক্যু কে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসলেন। বলশেভিকদের মাঝে সব থেকে প্রতিভাবান সংগঠক লিওন ট্রটস্কি, তাকে জেলখানা থেকে মুক্তি দিয়ে সশস্ত্র জঙ্গি বাহিনী – রেড গার্ডের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে রেড গার্ড বা রেড আর্মি গঠিত হয়েছিল শ্রমিকদের নিয়ে, যারা বলশেভিক পার্টিকে সমর্থন করত। লিওন ট্রটস্কি শহরের মুল স্থানগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকেন। অন্যদিকে রেলের কর্মীরাও বিদ্রোহ করে বসেন যাদের অনেকেই ছিলন বলশেভিক পার্টির সমর্থক। তারা জেনারেল কর্নিলভের বাহিনীকে রেল যোগে পেট্রোগার্ডে যেতে বাঁধা দেয়। এতে অনেক সৈন্য বাড়ি ফিরে যায় কেউ বা বলশেভিকদের দলে যোগ দেয়।

মুখরোচক প্রচার প্রতুশ্রুতিতে পেট্রগার্ড সোভিয়েতে বলশেভিকরা সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। লেলিন তখন ভাবলেন যে এটাই উপযুক্ত সময়, ফিনল্যান্ড থেকে সে গোপনে পেট্রগার্ডে ফিরে আসে এবং ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। ২৫ অক্টোবর বলশেভিকরা আন্দোলন শুরু করে, রেড গার্ড ও অধীনস্ত সৈন্যরা শহরের প্রধান প্রধান স্থানগুলো দখল করে নেয়। ১৯১৭ এর ৭ নভেম্বরে(নতুন রীতি) রেড বাহিনী, Military Revolutionary Committee এর অধীনে থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন দপ্তর ও ভবনগুলো দখল করে। এর পরেরদিন তারা অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের কার্যালয় Winter Palace দখল করে। এর পর লেলিন আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্বতীকালীন সরকারের পতন ঘোষণা করেন। এর পরে বলশেভিকরা সকল ক্ষমতা তাদের হাতে নিয়ে নেয়।

অক্টোবর বিপ্লবের ফলাফল

কিন্তু এতেও বলশেভিকদের পথের কাঁটা দূর হয়না। দেশের মাঝে তখনো কিছু অভিজাত শ্রেণির মানুষ ছিল যারা নিকোলাসকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে চাইত। কিছু সংখ্যক সৈন্যেরও জার পরিবারের প্রতি সমর্থন ছিল। এরা সবাই মিলে গঠন করে Russian White বাহিনী. পরবর্তীতে এ বাহিনী বিদেশি সমর্থনও লাভ করে। ফলে রেড বাহিনী ও হোয়াট বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ বাধে। যা রাশিয়ায় এক দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। কিন্তু তাতেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি জার সমর্থিত হোয়াট বাহিনীর। বলশেভিকদের হাতে তাদেরকে পরাজিত হতে হয়। আর বলশেভিকরা শুধু Russian White বাহিনী কেউ পরাজিত করেনি সেই সাথে অন্যান্য যেসকল সমাজতান্ত্রিক দল, উপদল ছিল তাদেরও দমন করতে সমর্থ হয়।

রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ বিংশ শতাব্দীর বিপর্যয়কারী যুদ্ধগুলোর একটি। আনুমানিক বিশ লক্ষ সৈন্য তাদের জীবন হারান। দুর্ভিক্ষের সাথে অনেক রোগ মহামারি আকার ধারণ করে। ১৯২১ সালের শেষের দিকে ভ্লাদিমির লেলিনের বলশেভিক পার্টি এ যুদ্ধে জয়লাভ করে। ১৯২২ সালে অবিসংবাদিত লেলিনের দৃঢ় নেতৃত্বে এক নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যা পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র- সোভিয়েত ইউনিয়ন(The creation of the Union of Soviet Socialist Republics- USSR)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পতনের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু সবসময় গণতন্ত্রকামী মানুষের মনে যা আসে তা হল এটি একক রাজনৈতিক দলের দেশ, এখানে সকল বিরোধীতা, ভিন্নমতাদর্শ কঠোর হস্তে দমন করা হয়।

Add a Comment