সড়ক দুর্ঘটনা

প্রথম আলো, ২৭ জুন ২০১৮
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করুন
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কত বড় একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে, তা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারছি। ২৪ ঘণ্টায় ৫২ জন মানুষের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াসহ শতাধিক ব্যক্তির আহত হওয়ার মতো সড়ক দুর্ঘটনাগুলো গত কয়েক দিনে ঘটেছে। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের হতাহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যেন সড়ক-মহাসড়কে প্রাণ হারানো এক অনিবার্য অভিশাপ হিসেবে আমাদের বয়ে বেড়াতেই হবে, যেন এটা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই।

কিন্তু এটা নিরুপায় দশা কোনোভাবেই নয়; জীবন-মৃত্যু নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েই চলতে হবে, আমাদের কারোরই করার কিছু নেই—এ ধরনের হতাশাব্যঞ্জক মনোভাব অবশ্যই পরিত্যাজ্য। মানবজীবন সমস্যায় পরিপূর্ণ, তবে কোনো সমস্যাই অপ্রতিকার্য হতে পারে না। আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক খবর হলো, সড়ক দুর্ঘটনার এই বাড়বাড়ন্ত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও সরব করে তুলেছে। গত সোমবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এ থেকে পরিষ্কার হলো সমস্যাটি কত গুরুতর। এ থেকে আরও স্পষ্ট হলো যে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব এই সমস্যার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলোর একটি হলো এই যে যানবাহনের কোনো চালক টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি যান চালাবেন না। খুবই মোক্ষম জায়গায় হাত দেওয়া হয়েছে। কারণ, এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই ঘটে চালকদের কারণে। বেপরোয়াভাবে যান চালানো এবং একটানা দীর্ঘ সময় চালানো দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। তাই প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বিনা ব্যতিক্রমে দেশের সবখানে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যানবাহনের মালিকদের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন, তাঁরা যেন একই চালককে দিয়ে দীর্ঘ সময় যানবাহন না চালান, সেটা পরিবহনমালিকদের সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। ঈদের সময় দূরপাল্লার অনেক যাত্রীবাহী বাসের চালক প্রয়োজনীয় ঘুম ও বিশ্রাম বাদ দিয়ে টানা ১৮-২০ ঘণ্টা বাস চালিয়ে থাকেন। এটা সম্পূর্ণভাবে ও চিরতরে বন্ধ করতে হবে। চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধার ওপর প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়েছেন। এটাও নিশ্চিত করতে হবে এবং এ জন্য বাস কর্তৃপক্ষের তৎপরতা এবং যাত্রীসাধারণের সচেতনতা বাড়াতে হবে।

দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী যানবাহনের চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রশিক্ষণ ও অদক্ষ চালক-সহকারীদের কারণেও অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে প্রশিক্ষিত চালক ও সহকারীর ভীষণ ঘাটতি রয়েছে; তাঁদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ দেশে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে রাস্তা পারাপারের সময়, চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে হেঁটে রাস্তা পারাপারের প্রবণতা ঢাকা শহরে অত্যন্ত বেশি। প্রধানমন্ত্রী এদিকেও যথার্থই দৃষ্টি দিয়েছেন: তিনি বলেছেন, অতিনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে, সে জন্য সিগন্যাল মেনে চলতে হবে, জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের নৈরাজ্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থায় অনেক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব; পথেঘাটে মানুষের অসতর্ক ও অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব।

এসব ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনা রোধের উপায় হিসেবে গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের অনেক সুপারিশ-পরামর্শ রয়েছে। সেসব সুপারিশ বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে রয়েছে। প্রয়োজন সেগুলো বাস্তবায়নের সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের দেখভাল করার জন্য সরকারের তিন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। আমরা আশা করি, মন্ত্রীরা তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহনমালিক, শ্রমিক ও যাত্রীসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সড়ক দুর্ঘটনার হার ক্রমশ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি।

Add a Comment