বিভিন্ন সময়ে ভারত – বাংলাদেশ সম্পর্ক

এই টপিকটা এতটাই গুরুত্বপুর্ন যে,আগামী এক বছের বিসিএস সহ যেকোন সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রিলি,লিখিত, ভাইবা অংশে অবশ্যই লাগবে। তাই চেষ্টা করেছি একটি সুন্দর নোট উপহার দিতে। সবার অনুরোধ আর সুবিধার্থে ৩ পর্ব একসাথে দিলাম। ইন্টারনেট, বিভিন্ন বই,পত্রিকা, বাংলা একাডেমির বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক বই ইত্যাদি জায়গা থেকে গ্রহনযোগ্য তথ্য নিয়ে এই লেখাটা তৈরি করেছি। আশা করছি আগামী ১বছরে যেকোন নিয়োগ পরীক্ষায় (বিশেষত লিখিত অংশে) এই অংশটি দিয়ে বাজিমাৎ করতে পারবেন।
——–
দেশ ভাগঃ দেশ বিভাগের আগে স্যার রেডক্লিপের নেতৃত্বে যে স্থলসীমান্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল,তাদের নির্ধারিত সীমানা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক দেখা দেয় তৎকালীন পাকিস্থান ও ভারতে।বিশেষ করে ছিটমহলগুলো নিয়েই বড় সমস্যা দেখা দেয়। এসব সমস্যা সমাধানে ১৯৫৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মধ্যে চুক্তি সই হয়। যদিও সেটি কার্যকর হতে পারেনি দুই দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতির কারনে। ঐ চুক্তিতে ভারতের মধ্যে থাকা বেরুবাড়ি ছিটমহল পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের ভূ-খন্ড বেষ্টিত ২টি ছিটমহল -দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার ভাগ্য অমীমাংসিত থেকে যায়।১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে বেরুবাড়ি ভারতের হাতে প্রত্যর্পণ করা হয় এবং দহগ্রাম আঙ্গরপোতাকে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ করার জন্য ঐ ২টি ছিটমহল সংযুক্ত করতে কুচলিবাড়ির ৩ বিঘা জমি (দৈর্ঘ্য ১৭৮মিটার ও প্রস্থ ৮৬মিটার) ভারতের কাছ থেকে স্থায়ী লিজের ব্যবস্থা করা হয়। এ কারণেই এটি ৩ বিঘা করিডোর নামে পরিচিত।

উল্লেখ্য,বাংলাদেশের সীমান্ত ৩দিকে ভারতের ৫টি রাজ্যের সাথে সংযুক্ত রয়েছে ৪হাজার ৯৫কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমঙ্গের সঙ্গে ২হাজার ২১৬ কিলোমিটার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল। এসব ছিটমহল অন্য রাষ্ট্র দ্বারা বেষ্টিত থাকায় এর বাসিন্দারা যে দেশের নাগরিক হিসেবে আইনত স্বীকৃত, সেই দেশ থেকে ছিল সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সুবিধা থেকে ও তারা বঞ্চিত ছিল।
পাকিস্তান আমলে এর পরিস্থিতিঃ ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে সুইডেনের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এলগট বেগিকে চেয়ারম্যান করে বাউন্ডারি ডিসপুটস ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৫৮ সালে নেহেরু-নূন চুক্তি সইয়ের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু লোকসভায় বলেছিলেন, “ভূ-খন্ড (ছিটমহল) বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা চাইনা,সেসব এলাকার মানুষ অভিবাসী হয়ে থাক। যে দেশের মধ্যে তারা আছে, সে দেশেই তারা থাকবে।

স্বাধীনতার পর এর পরিস্থিতিঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুই দেশই সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয় এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লীতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখু মুজিবুর রহমানএর মধ্যে আরেকটি সীমান্ত চুক্তি হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ভেতরে থাকা দক্ষিন বেরুবাড়ি ভারতের দখলে চলে যায় এবং দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা বাংলাদেশেরর অধিকারে আসে। ছিটমহল ২টি বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় পানবাড়ি মৌজার সাথে যুক্ত করার জন্য তিনবিঘা জমি ভারত বাংলাদেশের অনুকুলে স্থায়ী ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। চুক্তি সইয়ের পরপরই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এটি অনুমোদন করে। কিন্তু ভারত তখন সেটি অনুমোদন করেনি।

জিয়ার শাসনামলে এর পরিস্থিতিঃ ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন দেখা দিলেও সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৮ সালে তাঁর নয়াদিল্লী সফর ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের ঢাকা সফরকালে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি উত্থাপিত হয়। বাংলাদেশ তিনবিঘা করিডোর হস্থান্তরের উপর জোর দেয়।


১৯৭৭ সালে পশ্চিমঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে সীমান্ত চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রের সাথে তাদের বিরোধ লক্ষ করা যায়। বামফ্রন্টের অন্যতম শরিক ফরোয়ার্ড ব্লক প্রবলভাবে তিনবিঘা করিডোর হস্থান্তরের বিরোধিতা করে। তারা গঠন করে তিনবিঘা আন্দোলন কমিটি।
এরশাদ শাসনামলে এর পরিস্থিতিঃ ১৯৮১ সালের ৩০মমে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালের ৬-৭অক্টোবর তিনি দিল্লী সফর করেন এবং ৩বিঘা করিডোর নিয়ে ভারতের সাথে সমঝোতায় আসেন। সীমান্ত চুক্তির ১ নং অনুচ্ছেদের ১৪নং ধারা অনুযায়ী ৩বিঘা করিডোর বাংলাদেশের অনুকুলে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার উদ্দ্যেশ্য দুই দেশের সরকার এক সমঝোতা স্মারক সই করেন। ঐ সময় ভারত এই নিশ্চয়তা দেয় যে ১৯৭৮ সাকের স্থলসীমান্ত চুক্তি পার্লামেন্টে অনুস্বাক্ষর না হলেও যথাসম্ভব তিনবিঘা করিডোর বন্দোবস্তের শর্তাবলী পূরণ করবে। এব্যাপারে ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে পত্র বিনিময় হয়,যা পরবর্তীকালে চুক্তির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।


এই করিডোর হস্থান্তরের আহির্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ জেলার পাটগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল যুক্ত করার জন্য ভারত আওরকার স্থায়ীভাবে তিন বিঘা পরিমান জমি বাংকাদেশকে ইজারা দেবে,এর বিনিময়ে বাংলাদেশ সরকার বছরে এক টাকা হারে খাজনা দেবে ভারতকে। এতে আরো বলা হয় যে,খাজনা দিতে হবে না এ কারনে যে ভারত সরকার তার দাবী পরত্যাগ করেছে। এ চুক্তি অনুযায়ী পুলিশ,বিডি আর (বর্তমান বিজিবি), সামরিক বাহিনীসহ বাংলাদেশের যেকোন নাগরিক করিডোর ব্যবহারের পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে।
কিন্তু ফরোয়ার্ড ব্লকের বিরোধীতার কারণে তিনবিঘা ইজারা প্রক্রিয়া থেমে যায়। ভারতের কুচলিবাড়ি এলাকার বাসিন্দারা হাইকোর্টে এর বিরুদ্ধে মামলা করেন।


খালেদা জিয়ার শাসনামলে এর পরিস্থিতিঃ ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জে এন দীক্ষিত বাংলাদেশের তৎকালীন অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব এ এইচ মাহমুদ আলীকে একটি চিঠি দেন,যিনি বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রী। এর জবাবে মাহমুদ আলী ফিরতি চিঠিতে তিনবিঘা করিডোর হস্থান্তরের শর্তাবলী নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ১১ দফা সমঝোতার কথা জানান। এরপর ২৬-২৮মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দিল্লি সফরের সময় তিনবিঘা করিডর হস্থান্তরের ব্যাপারে আরেকটি সমঝোতা হয়। এ প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালের ২৬ জুন থেকে বাংকাদেশের কাছে তিনবিঘা করিডরের হস্থান্তর কার্যকর হয়। যদিও সেই বন্দোবস্ত ছিল শর্তসাপেক্ষ এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত গেট খোলার ব্যবস্থা করা হয়।

শেখ হাসিনার আমলে এর পরিস্থিতিঃ শেখ হাসিনার ১ম সরকারের আমলে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি হলেও সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তেমন এগোয়নি। তবে ভারতের সহায়তায় পার্বত্য চুক্তি সই হয়,ভারতে অবস্থানরত শরনার্থীরা দেশে ফিরে আসে। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় সরকার ভারতের সাথে ‘অনুপ্রবেশ ‘,সীমান্তে সংঘাত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সীমান্ত চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়নি বললেই চলে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে স্থলসীমান্ত ও সমুদ্র সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেয়। আন্তর্জাতিক আদালত ও সালিসির মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারন করার কাজটি সম্পন্ন হয়। স্থলসীমান্থ বিরোধ নিষ্পত্তিতে ২০১১ সালে প্রটোকল সই হয় এবং সম্প্রতি ভারতীয় পার্লামেন্টে ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুমোদন পায়।

ছিটমহলে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ঃ ইন্দিরা -মুজিব চুক্তি নামে পরিচিত ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তিটি (৫টি অনুচ্ছেদ ও ১৫টি উপ অনুচ্ছেদ সম্বলিত) গত ৫মে ২০১৫ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। এরপর ৬ মে ২০১৫ তা ভারতের রাজ্যসভায় এবং ৭মে ২০১৫ লোকসভায় পাশ হয়। পাশকৃত বিলে ভুল থাকায় ১১মমে ২০১৫ সে ভুল শুধরে তা রাজ্যসভায় পুনরায় উত্থাপন করা হয় এবং পাস হয়। এভাবে ৩১জুলাই ২০১৫ মধ্যরাতে অর্থাৎ ১আগস্ট ২০১৫ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনিময়ের মাধ্যমে মানচিত্র থেকে মুছে যায় “ছিটমহল ” নামের শব্দটি। শুধু ছিটমহলই নয়,ঐদিন দু ‘দেশের সীমানায় থাকা ৫,০৪৪.৭২ একর বিরোধপূর্ণ (অপদখলীয়) ভূমিও দু’দেশের মধ্যে বিনিময় হয়। ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের মাধ্যমে বদলে যায় বাংলাদেশে ও ভারতের মানচিত্র।

শুভেচ্ছান্তেঃ সত্যজিৎ চক্রবর্ত্তী

Add a Comment