পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ও সেবা খাত****

Somewhereinblog, ২৭ শে জুলাই, ২০০৯


মহাজোট সরকারের প্রথম বাজেটের সবচেয়ে আলোচিত অংশ হল কালো টাকা সাদা করার অনুমতি বহাল রাখা প্রসঙ্গে। তার পরেই আছে পিপিপি বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব।
অর্থমন্ত্রণালয় পিপিপি সম্পর্কে একটা ধারণাপত্র, অর্থমন্ত্রীর ভাষায় পজিশন পেপার তৈরি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সাধারণত সরকারি কোন নির্মাণ কাজ বা সরবরাহ ‘টেন্ডার বা প্রতিযোগিতামূলক নিলামের মাধ্যমে ঠিকাদার সরবরাহকারীর কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়। এ কেনাকাটা একটা এককালীন বিষয়, নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে বা সরবরাহ করা হয়ে গেলে ওই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার বা সরবরাহকারীর কোন দায়-দায়িত্ব থাকে না। কিন্তু পিপিপি’র মাধ্যমে সরকার বা জনগণ একটা চুক্তিনামার আওতায় বেসরকারি সেক্টরের কোন প্রতিষ্ঠান বা অবকাঠামো থেকে নির্দিষ্ট ফি বা দাম দিয়ে সেবা কিনে নেয়। ওই অবকাঠামোর ‘অর্থ যোগানো, নির্মাণ কাজ ব্যবস্থাপনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ সবই করে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অবশ্য সরকারের ‘অনুমোদন ও সহযোগিতা’ নিয়ে।

ওয়েবসাইটে পিপিপি’র কয়েকটি মডেল আছে যার কোন কোনটা বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই কার্যকর আছে। যেমন-
Build Own Operate(BOO): সহজ কথায় এর অর্থ হল অবকাঠামো নির্মাণ, মালিকানা ও পরিচালনা সবই করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি উদ্যোগের নামে এ মডেলটি কার্যকর আছে।

Build Operate Transfer(BOT): দ্বিতীয় মডেলটি হল, বিওটি (বিল্ড অপারেট ট্রান্সফার) অর্থাৎ অবকাঠামোটি বেসরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা পরিচালনা করবে সংশ্লিষ্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ওই সময় শেষ হয়ে গেলে তার ব্যবস্থাপনা সরকারের হাতে চলে আসবে। এ মডেলটি কার্যকর আছে গ্যাস খাতে বিভিন্ন পিএসসি চুক্তির আওতায়।

Build Operate Own Transfer(BOOT): তৃতীয় মডেলটি হল, বিওওটি (বিল্ড অপারেট ওউন ট্রান্সফার) অর্থাৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অবকাঠামোটি নির্মাণের পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা পরিচালনা করবে। তারপর তার মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা সরকারের হাতে দিয়ে দেবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে এ তিনটির বাইরে আরেকটি মডেল কার্যকর আছে, তা হল, সরকার অবকাঠামো নির্মাণের পর তার ব্যবস্থাপনা, ক্ষেত্রবিশেষে মালিকানা, বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয় এবং নির্দিষ্ট ফি বা দাম দিয়ে তার কাছ থেকে সেবা কিনে নেয়। এ মডেলের আওতায়ই জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রসহ বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিআরটিসি’র বহু বাস এ নিয়মে চলছে। কয়েকটি ট্রেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়ার পর রেল খাতেও তা কার্যকর আছে।

ধারণাপত্রটিতে এ মডেলগুলোর ফলে সরকার, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগণ বা ভোক্তারা কী কী সুবিধা পেয়ে থাকে তা-ও বেশ বিস্তারিত বলা আছে। আমি এখানে শুধু ভোক্তা বা জনগণের দিকটাই আলোচনা করব। কারণ, গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে এ দেশের মালিক জনগণ, আর চূড়ান্ত বিচারে সব সম্পদেরই যোগানদাতা হল সাধারণ জনগণ, তাদের সুবিধা-অসুবিধাই যেকোন বিনিয়োগের সাফল্য-ব্যর্থতা বিবেচনার ক্ষেত্রে ভিত্তি হওয়ার কথা।

ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, টাকা দিয়ে সেবা কেনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকার ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। তদারককারী হিসেবে সরকার অধিকতর দায়িত্বশীল হবে এবং দুর্ঘটনা বা ক্ষয়-ক্ষতিজনিত খরচ কমাতে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার জন্য টেকসই ও ভাল মালমশলা বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবে।

অবশ্য, ধারণাপত্রে এ সবের পাশাপাশি কিছু ঝুঁকির কথাও বলা হয়েছে। ঝুঁকিগুলো হল, সম্পত্তির ওপর জনগণের মালিকানা হারানো, প্রকল্প ব্যয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো, সেবার দাম নির্ধারণের সময় জনস্বার্থ উপেক্ষিত হওয়া ইত্যাদি। বাস্তবে কোনটা সত্য হতে পারে?

আমার বিবেচনায় সুবিধার চেয়ে ঝুঁকির কথাগুলোই বাস্তব হয়ে ওঠতে পারে। ইতোপূর্বের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। সবার জানা আছে যে পিএসসি বা উৎপাদন বন্টন চুক্তির মাধ্যমে আমাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে লেখা আছে উৎপাদন খরচ না ওঠা পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানি গ্যাসের শতকরা ৭৯ ভাগ পাবে, আমরা পাব ২১ ভাগ। উৎপাদন খরচ ওঠার পর আমাদের গ্যাসের হিস্যা বাড়বে। কিন্তু দেখা গেছে, কোম্পানির কর্মকর্তাদের বেতন-বাড়ি-গাড়ি ভাড়া, এমনকি কথিত বিনোদন খরচকেও যুক্ত করে উৎপাদন খরচ এতটাই বাড়িয়ে ধরা হয়েছে যে, গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ওই খরচ নাকি তোলা যায়নি। ব্রিটিশ কোম্পানি কেয়ার্ন পরিচালিত বঙ্গোপসাগরের সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র তার সাক্ষী।

পিএসসিতে আরও বলা হয়েছে, ওদের ভাগের গ্যাস আমাদেরকে কিনতে হবে বিদেশি মুদ্রায় এবং দাম নির্ধারিত হবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামকে ভিত্তি করে। এর ফল হয়েছে, বর্তমানে আমাদেরকে ওদের কাছ থেকে পেট্রোবাংলার চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ওরা মাঝে মাঝেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছে এবং বেশি মুনাফার লোভে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রয়ের অনুমতির জন্য চাপ দিচ্ছে। এর প্রভাবে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। সবচেয়ে বড়কথা, গ্যাসের জন্য আমরা ওদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি।

বিদ্যুৎ খাতেও একই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে অসম আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) চুক্তির কারণে প্রতিবছর বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, পিডিবি’র প্ল্যান্ট বন্ধ রেখে ওদেরকে সস্তা দরে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। এ কারণে পিডিবির ক্ষতি এতটাই বেড়ে গেছে যে, তা দিয়ে বছরে অন্তত ২০০ মেগাওয়াটের একটি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন।

ধারণাপত্রে এ সব ক্ষতি মোকাবেলায় উপযুক্ত আইন ও বিধি প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ এবং এগুলোর তত্ত্বাবধান ও নজরদারির জন্য পর্যাপ্ত বেতন দিয়ে দক্ষ বিশেষজ্ঞ ও জনবল নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব চুক্তি বা আইনবিধি করবে কে? বর্তমান মহাজোট সরকারই তো, ওপরে যে পিএসসি ও আইপিপি’র কথা বলা হয়েছে সেগুলো আওয়ামী লীগই করেছিল এদের ক্ষমতার ১৯৯৬-২০০১ সালপর্বে। পরবর্তী বিএনপি-জামাত জোট সরকার তা বহাল রেখেছে এবং নতুন কিছু চুক্তি করেছে। ফলে কাঁঠাল গাছে আম আশা করাটা কোনমতেই সঙ্গত হতে পারে না।

পিপিপি’র আওতায় বিনিয়োগের জন্য যে খাতগুলোকে বেছে নেওয়া হয়েছে তার প্রায় সবকটিই সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে সমস্ত জনগণের মৌলিক প্রয়োজনগুলো জড়িত। যেমন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতো বটেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পানির মতো বিষয়গুলো জনস্বার্থের দিক থেকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এগুলোকেও পিপিপি’র আওতায় দেশি-বিদেশি মুনাফা শিকারিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফল খুব ভয়াবহ হতে বাধ্য। এখনই এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি ২ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হয়। পিপিপি’র মাধ্যমে ওয়াসা ও বিভিন্ন পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা যদি মুনাফা শিকারীদের কবলে যায় তখন এর অবস্থাটা কী দাঁড়াতে পারে?

শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষত উচ্চশিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণের দাপটে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণদের মাত্র শতকরা ৪ ভাগ সুযোগ পায়। এদের মধ্যে এখনও কম হলেও কিছু নিম্নবিত্ত জায়গা পায়। কিন্তু, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বা সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পিপিপি’র আওতায় গেলে তা কি সম্ভব হবে? ঠিক একই প্রশ্ন স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নিম্নবিত্ত মানুষেরা এখন বহু হয়রানি সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালগুলিতে একটু-আধটু চিকিৎসা পায়। মুনাফা শিকারিরা সুযোগ পেলে যে এদেরকে এখান থেকে ছিটকে ফেলে দেবে এ কথা জোড় দিয়েই বলা যায়।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় যতই বলুন, পিপিপি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ‘মানুষকে দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে মুক্ত’ করবে, সাধারণ জনগণ তাতে আশ্বস্ত হতে পারে না। তাদের কাছে পিপিপি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকের হাতে তুলে দেওয়ারই পন্থা বিশেষ। সাধারণ জনগণ এতদিন যেসব সেবা অপ্রতুল হলেও তাদের মৌলিক অধিকার হিসেবে অল্প ফি দিয়ে ভোগ করত, পিপিপি এগুলোকে বাজারি পণ্যে পরিণত করবে। পরিণামে মুনাফাশিকারিদের জন্য জনগণের পকেট কাটার একটা ‘বৈধ’ সুযোগ তৈরি হবে।

পকেট কাটার বিষয়টা নিয়ে কারও সংশয় থাকলে আশুলিয়া সড়কের কথাটা উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, ওই সড়কটি ৫ বছরের জন্য ৫ কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইজারাদার একবছরেই তুলে নিয়েছে ৩ কোটি টাকা, ৫ বছরে তোলা যাবে কম করে হলেও ১৫ কোটি টাকা। যে সড়কে বিনা পয়সায় চলাচলের কথা ছিল সে সড়কে চলতে গিয়ে ১৫ কোটি টাকা গচ্চা! কে দিল আর কে পেল?

অর্থমন্ত্রী বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাসপাতাল, স্কুল ও রাস্তাঘাট নির্মাণকে বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক (!) বলে এসব খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে বাজেটে ৩০০ কোটি টাকা ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছেন। তাছাড়া ওদেরকে মূলধন যোগানোর জন্য বাজেটে আরও ২১০০ কোটি টাকা ‘অবকাঠামো বিনিয়োগ তহবিল’ হিসেবে রেখেছেন। বলা হয়েছে ‘এ তহবিল থেকে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা হবে।’ ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ১৫ কোটি টাকা আয় হওয়ার পরও ভর্তুকি বা আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে?

সরকার বাজেটে কিছু কল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সামান্য বরাদ্দ বৃদ্ধি, কোনো কোনো আমদানি পণ্যে কর বৃদ্ধি দেখে কেউ কেউ অর্থনীতি কল্যাণমূলক খাতে বাঁক নিয়েছে বলে দাবী করেছেন। যদিও বাস্তবে সরকার মুক্তবাজার নীতিতেই অটল আছেন। মুক্তবাজার নীতির পোশাকি নাম নয়া-উদারবাদী নীতি যার মূলকথা হল, সবকিছুকেই বাজারের পণ্যে পরিণত করতে হবে, কোন কিছুই মুনাফা শিকারিদের আওতার বাইরে রাখা যাবে না। অভাবের কারণে মানুষ কোন শিল্প বা কৃষিপণ্য না কিনতে পারে, জরুরি সেবা কেনা তো আর বাদ দিতে পারবে না। তাই মুনাফার চাকা সচল রেখে পুঁজিবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে শিল্প-কৃষির পাশাপাশি শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পানি সরবরাহের মতো জরুরি সেবাগুলোকেও পুঁজিপতিদের মুনাফা শিকারের জন্য খুলে দিতে হবে।

এখন এর পরিণতি কী দাঁড়াবে? কাগজে-কলমে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি হয়ত ঘটবে, কিন্তু মৌলিক সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য আরও প্রকট হবে। টাকাওয়ালারা এখনকার মতোই উন্নতমানের সেবাগুলো ভোগ করবে, কিন্তু টাকাহীনেরা এখন যতটুকু পাচ্ছে তা থেকেও বঞ্চিত হবে। হ্যাঁ, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় কিছু হয়তো তাদের ভাগে পড়বে, তবে তা যে ভিজিডি-ভিজিএফ ও টেস্ট রিলিফের চাল ও গমের মানেরই সমতূল্য হবে নির্দ্বিধায় তা বলা যায়।

Add a Comment